দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার মধ্যে পার্থক্য

দেওয়ানি মামলা (Civil case):

নিজের অধিকার আদায়ে সম্পত্তির ওপর স্বত্ব ও দখলের জন্য যে মামলার মাধ্যমে নিষ্পত্তি করা হয় তাকে সাধারণত দেওয়ানি মামলা বলা হয়। এ ছাড়া মানহানির কারণে বা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার কারণে আর্থিক ক্ষতিপূরণ চেয়ে মামলা করলেও তা দেওয়ানি মামলার অন্তর্ভুক্ত হয়। দেওয়ানি মামলার অনেক ধরন রয়েছে। আর্থিক ক্ষতিপূরণের মামলা, সব ধরনের স্বত্ব, মানবিক সম্পর্ক (পিতা-পুত্র, স্বামী-স্ত্রীর সম্পর্ক) নিয়ে বিরোধ, মসজিদ, মন্দির, গীর্জায় প্রার্থনা করার অধিকার, ভোটাধিকার ইত্যাদি।

নিজের সম্পত্তি থেকে বঞ্চিত হলে তিনি সম্পত্তির অধিকার ফিরে পাওয়ার জন্য আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। তবে এ ক্ষেত্রে আদালতের এখতিয়ার অনুযায়ী মামলা দায়ের করতে হবে। কোনো ব্যক্তি ব্যবসা-বাণিজ্য বা ট্রেড লাইসেন্স এবং বইয়ের স্বত্ব কাউকে দেওয়ার পর যদি ওই ব্যক্তি এসব স্বত্বাধিকার থেকে বঞ্চিত হোন তাহলে তিনি এ অধিকার ফিরে পেতে আদালতে মামলা দায়ের করতে পারেন। মা-বাবা বৃদ্ধ হলে ছেলে যদি তাঁদের জন্য কোনো ভরণপোষণ না দেয় তাহলে আদালতে ভরণপোষণ চেয়ে মামলা দায়ের করা যায়। এ ছাড়া স্ত্রীর ভরণপোষণ না দিলে স্ত্রী ভরণপোষণ চেয়ে মামলা দায়ের করতে পারেন।

ফৌজদারি মামলা (Criminal case):

ব্যক্তির অধিকার ও সম্পত্তির অধিকার ব্যতিত যেকোনো অপরাধ ফৌজদারি মামলার অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের বিচার ব্যবস্থায় রাজনৈতিক হাঙ্গামা, ব্যক্তির জীবন হরণ, অর্থসম্পদ লুটপাট ও যৌন হয়রানির অপরাধে ফৌজদারি মামলার ব্যবহার সবচেয়ে বেশি। এক কথায় চুরি, ডাকাতি, খুন, জখম, প্রতারণা, দস্যুতা, লুটপাট, বিস্ফোরণ, ধর্ষণ, অপহরণ, বেআইনি সমাবেশ, যৌন হয়রানি, জালিয়াতি, মিথ্যা সাক্ষ্য প্রদান প্রভৃতি অপরাধে যেসব মামলা দায়ের করা হয় তাকে ফৌজদারি মামলা বলা হয়। এসব মামলায় দোষী সাব্যস্ত হলে জেল জরিমানা, যাবজ্জীবন এবং মৃত্যুদণ্ড হয়ে থাকে।

সাধারণত ফৌজদারি মামলায় দুইভাবে চিহ্নিত করা হয়, আমলযোগ্য ও আমল অযোগ্য মামলা। আবার আমলযোগ্য মামলাকে দুই ভাগে ভাগ করা হয়, একটি জি আর বা পুলিশি মামলা অন্যটি সি আর বা নালিশি মামলা। আইন মোতাবেক কিছু অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়াই গ্রেপ্তার করতে পারবে। এসব ক্ষেত্রে থানার ভারপ্রাপ্ত র্কমর্কতা দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে আদালতে প্রতিবেদন দিয়ে থাকেন। এসব অপরাধে যে মামলা হয় তাকে আমলযোগ্য মামলা বলা হয়। কিছু অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ ওয়ারেন্ট ছাড়া গ্রেপ্তার করতে পারে না। অপরাধ সংঘটিত হলে পুলিশ সংশ্লিষ্ট ম্যাজিস্ট্রেটের অনুমতি নিয়ে সর্বোচ্চ ৬০ দিনের মধ্যে প্রসিকিউিশন ওয়ারেন্ট বা নন-এফআইআর মামলা আদালতে দাখিল করেন। এগুলো আমল অযোগ্য মামলা। এ ধরনের অপরাধের মামলা কোর্টের নন-জিআর রেজিস্ট্রারভুক্ত হয়ে পরিচালিত হয় বলে এ মামলাকে নন-জিআর মামলা বলা হয়।

ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে সরাসরি গিয়েও কোর্ট ফি দিয়ে বিচার প্রার্থনা করা যায়। এ ক্ষেত্রে কার্যবিধির ২০০ ধারায় শপথ নিয়ে আবেদনের উল্টো পিঠে জবানবন্দি রেকর্ড করতে হয়। কোর্ট রেজিস্ট্রার মামলা নথিভুক্ত করে পরিচালিত হওয়ার কারণে এগুলোকে সিআর মামলা বলা হয়।

দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার মধ্যে পার্থক্যঃ

ব্যক্তির অধিকার ও সম্পত্তির অধিকার ব্যতিত যেকোনো অপরাধ ফৌজদারি মামলার অন্তর্ভুক্ত। দেওয়ানি ও ফৌজদারি মামলার মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-

১। দেওয়ানী মামলা ব্যবস্থায় মানুষের সাধারণ ও ব্যক্তিগত অধিকার ক্ষুন্ন হলে প্রতিকারের ব্যবস্থা করে। আর্থিক ক্ষতিপূরণ ও অন্যান্য প্রতিকারের মাধ্যমে বাদীর অধিকার প্রতিষ্ঠা করা হয়। অন্যদিকে, ফৌজদারি বিচার ব্যবস্থায়, যারা সামাজিক শৃঙ্খলা বিঘ্নিত করা এবং অন্যের শারীরিক বা সম্পত্তির মারাত্মক ক্ষতি করার মতো অপরাধ করে তাদের শাস্তি দিয়ে প্রতিকার প্রদান করা হয়।

২। ব্যক্তিগত অধিকার কিংবা আইনগত স্বত্ব নিয়ে বিরোধ দেখা দিলে দেওয়ানী বিচারের মাধ্যমে অধিকার পুনর্বহাল করা হয়। অন্যদিকে, গণ-অধিকার ক্ষুন্ন করে সামাজিক শান্তি-শৃঙ্খলা বিঘ্ন করা হলে কিংবা ফৌজদারী দন্ডবিধিতে বর্ণিত অপরাধগুলি সংঘটিত করলে ফৌজদারী বিচারের মাধ্যমে অপরাধীকে শাস্তি প্রদান করা হয়।

৩। ফৌজদারী মামলার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে সংঘটিত অপরাধের শাস্তি নিশ্চিত করা। অন্যদিকে, দেওয়ানী মোকদ্দমার প্রধান উদ্দেশ্য হচ্ছে পক্ষদ্বয়ের অধিকার প্রতিষ্ঠা করা শাস্তি প্রদান নয়।

৪। ফৌজদারি মামলায় শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে অভিযুক্তের বিরুদ্ধে অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত হতে হয় ( Beyond reasonable doubt)। অন্যদিকে, দেওয়ানী মোকদ্দমার রায়, ডিক্রি প্রদানের ক্ষেত্র ভারসাম্যতার নীতি ( Balance of probability) অবলম্বন করা হয়।

৫। ফৌজদারী এর ক্ষেত্রে বলা হয় মামলা (Case)। অন্যদিকে, দেওয়ানী এর ক্ষেত্রে বলা হয় মোকদ্দমা (Suit)।

৬। দেওয়ানি মামলার ক্ষেত্রে বাদীকে সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয় না। অন্যদিকে, ফৌজদারি মামলার ক্ষেত্রে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষকেও সাক্ষী হিসেবে গণ্য করা হয়।

৭। দেওয়ানি মামলায় বাদীকে এবং ক্ষেত্র বিশেষে বিবাদীকে তার দাবী প্রমাণ করতে হয়। অন্যদিকে, ফৌজদারী মামলায় একমাত্র বাদীকে প্রমাণের দায়ভার বহন করতে হয়।

৮। দেওয়ানি মামলায় বাদীকে তার দাবী প্রতিষ্ঠিত করার জন্য সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণের কোন আবশ্যকতা নাই। অন্যদিকে, ফৌজদারী বিচারের ক্ষেত্রে আসামীকে শাস্তি প্রদানের ক্ষেত্রে বাদীপক্ষকে তার অভিযোগ সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সামান্য সন্দেহের অবকাশ থাকলে আসামীকে শাস্তি দেওয়া যায় না।