মহীসোপান ও মহীঢালের মধ্যে পার্থক্য

মহীসোপানঃ

মহীসোপান (Continental shelf) স্থলভাগ সন্নিহিত সমুদ্রতলের অংশ যেখানে পানির গভীরতা সর্বোচ্চ ২০০ মিটার। মহীসোপান বলতে মহাদেশীয় ভূভাগের স্থানীয়ভাবে নিমজ্জমান অংশকে বোঝায়। এগুলো খুবই সমতল তলাবিশিষ্ট এবং নতিমাত্রা ১:৫০০-এরও কম। অনেক বিশেষজ্ঞ মহীসোপানকে মহীচত্বর হিসেবে আখ্যায়িত করেন। মহীসোপানের গড় প্রস্থ প্রায় ৬৫ কিমি; কোথাও ২০/৩০ মিটার আবার কোথাও বা ১০০ কিলোমিটারেরও বেশি। অধিকাংশ মহীসোপানই স্থলভাগের অংশ হিসেবে থাকার সময়কার অর্জিত বৈশিষ্ট্যাদি আজও ধারণ করে আছে।

তাই দেখা যায় যে ১৫,০০০ বছর আগে যখন সমুদ্রপৃষ্ঠ আজকের তুলনায় প্রায় ১২০ মিটার নিচে ছিল, তখনকার হিমবাহ আবৃত স্থলভাগের কিংবা স্থলভাগের মধ্যকার নদীতলের উপাদান বা বৈশিষ্ট্যাদির চিহ্ন আজও বিরাজমান আছে। মহীসোপানের উপরিস্থিত অগভীর পানি গভীর ও অবারিত সমুদ্রের পানি থেকে পৃথক। উপকূলীয় নদীসমূহের প্রচুর দ্রবীভূত পুষ্টি উপাদান এই অগভীর পানিতে এসে মিশে যায়।

মহীঢালঃ

মহী অর্থ পৃথিবী এবং ঢাল হচ্ছে এমন একটি নিরাপদ বেস্তনী যার পর থেকে বিপদ বা কোন মূল জিনিসের আরম্ভ। সমুদ্রের মহীসোপান এর শেষ প্রান্ত যেখান থেকে হঠাৎ ভূ-পৃষ্ঠ খাড়াভাবে গভীরে চলে যেয়ে সামুদ্রিক খাতের ন্যায় সমুদ্রের মূল গভীরতা সৃষ্টি হয় তাকে মহীঢাল বলে। ধরুন আপনি একটি পুকুর বানালেন কিন্তু তা অনেকটা হাউজ আকৃতির। মানে পাড় বা কিনারা তীর্যকভাবে নিচু হতে হতে পুকুরের তলদেশে না যেয়ে হাউজের মত খাড়া হয়ে গর্ত সৃষ্টি করেছে। এরুপ পুকুরের পাড়কে সমুদ্রের ক্ষেত্রে মহীঢাল বলে।

এটি খাড়া ঢাল বিশিষ্ট হয় । সাধারণত এর গড় ঢাল ৫° এর কাছাকাছি হলেও স্থান বিশেষে এর তারতম্যও হতে পারে; যেমন – পার্বত্য উপকূলে এই ঢালের পরিমাণ ২৫° পর্যন্ত হতে পারে ।মহীঢালের গভীরতা ২০০ – ২০০০ মিটার, তবে স্থান বিশেষে তা ৪৫০০ মিটার পর্যন্তও হতে পারে। মহীঢাল অঞ্চল সমগ্র সমুদ্রতলের প্রায় ৮.৫ শতাংশ স্থান জুড়ে অবস্থান করছে ।মহীসোপান অঞ্চলের তুলনায় এই অঞ্চলে সঞ্চিত পদার্থসমূহ অতি সূক্ষ্ম হয় । শিলাখন্ড (১০ শতাংশ), বালি (২৫ শতাংশ), শৈবাল ও সামুদ্রিক কর্দম (৫ শতাংশ) প্রভৃতি এই অঞ্চলে সঞ্চিত হলেও কর্দম (৬০শতাংশ) বেশী পরিমাণেই পরিলক্ষিত হয় ।

মহীসোপান ও মহীঢালের মধ্যে পার্থক্যঃ

সমুদ্রজলে নিমজ্জিত মোটামুটি ১০০ মিটার গভীরতা পর্যন্ত মহাদেশীয় প্রান্তভাগকে মহীসোপান বলে। মহীসোপান ও মহীঢালের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরুপ-

১। মহাদেশের শেষ ভাগ গুলি ধীরে ধীরে ঢালু হয়ে সমুদ্রে নেমে গেছে । তট রেখা থেকে সমুদ্রের দিকে 200 মিটার বিস্তৃত মৃদু ঢালু অঞ্চল টির নাম মহীসোপান। অন্যদিকে মহীসোপানের শেষভাগ থেকে ভূভাগ হঠাৎ খাড়াভাবে নিচে নেমে গভীর সমুদ্রগর্ভ পর্যন্ত বিস্তৃত ঢালু অংশকে মহীঢাল বলা হয়।

২। উপকূল বরাবর মহাদেশীয় প্রান্তভাগ সমুদ্রের জলে অবনমনের ফলে মহীসোপানের সৃষ্টি হয়। অন্যদিকে মহীঢাল হল মহীসোপানের শেষ সীমানা থেকে গভীর সমুদ্র সমভূমি পর্যন্ত বিস্তৃত খাড়া অংশ।

৩। মহীসোপানের গভীরতা 200 মিটার পর্যন্ত হয়। অন্যদিকে মহীঢালের গভীরতা 2000 মিটার থেকে 2500 মিটার পর্যন্ত হয়ে থাকে।

৪। মহীসোপান অঞ্চল সমগ্র সমুদ্রতলের প্রায় 7.6 শতাংশ জায়গা জুড়ে বিস্তৃত। অন্যদিকে মহীঢাল সমগ্র সমুদ্রতলের 15 শতাংশ জায়গা জুড়ে বিস্তৃত।

৫। মহীসোপান অঞ্চলগুলি মৃদু ঢাল বিশিষ্ট হয় এবং ঢাল এর পরিমান 1 ডিগ্রির কম হয়। অন্যদিকে মহীঢাল অঞ্চলগুলি খাড়া ঢাল বিশিষ্ট হয় এবং ঢালের পরিমাণ 2 ডিগ্রি থেকে 5 ডিগ্রি পর্যন্ত হয়ে থাকে।

৬। ভূমি ঢালের পরিমাণ খুব কম হয় বলে মহীসোপান এ বিভিন্ন জৈব অজৈব পদার্থের সঞ্চয়ের পরিমাণ অনেক বেশি। অন্যদিকে ভূমিভাগ খাড়া ঢাল বিশিষ্ট হওয়ায় জৈব ও অজৈব পদার্থের সঞ্চয়ের পরিমাণ কম।

৭। মহীসোপান অঞ্চলে প্ল্যাংটনের এর প্রাচুর্য থাকায় বাণিজ্যিক মৎস্য চারণক্ষেত্রের বিকাশ ঘটে। মহীসোপান অঞ্চলে প্ল্যাংটনের অভাবে বাণিজ্যিক মৎস্য চারণক্ষেত্র গড়ে উঠতে পারে না।

৮। মহীসোপান অঞ্চল বন্দর ও প্রোতাশ্রয় গড়ে ওঠার ক্ষেত্রে অনুকূল পরিবেশ সৃষ্টি করে। অন্যদিকে মহীঢাল অঞ্চলে বন্দর ও পোতাশ্রয় গড়ে ওঠে না।

৯। মহীসোপান অঞ্চল থেকে প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল সংগৃহীত হয়। অন্যদিকে মহীঢাল অঞ্চলের প্রাকৃতিক গ্যাস ও খনিজ তেল পাওয়া যায় না।