খাদ্যশৃঙ্খল ও খাদ্যজালের মধ্যে পার্থক্য

খাদ্যশৃঙ্খল (Food Chain):

যে প্রক্রিয়ায় খাদ্যশক্তি নীচের পুষ্টি স্তর থেকে সর্বোচ্চ পুষ্টিস্তর পর্যন্ত অর্থাৎ উৎপাদক থেকে খাদ্যখাদক সম্পর্কীত বিভিন্ন জীবগোষ্ঠীর মধ্যে প্রবাহিত বা স্থানান্তরিত হয়, সেই শৃঙ্খলিত পর্যাক্রমিক শক্তির প্রবাহ বা স্থানান্তরকে খাদ্যশৃঙ্খল বলে। খাদ্য শৃঙ্খল বা খাদ্য শিকল হচ্ছে উৎপাদক জীব থেকে শুরু করে শীর্ষে অবস্থানকারী সর্বোচ্চ স্তরের খাদক বা শিকারী প্রজাতির (গ্রিজলি ভাল্লুক বা খুনে তিমির মতো) এবং বিয়োজক তথা মৃতভোজী (যেমন: কেঁচো বা ঘুনপোকা) এবং পচনকারীতে (যেমন ছত্রাক বা ব্যাকটেরিয়া) সমাপ্ত হওয়া কোনও খাদ্য জালের বিভিন্ন অংশের একটি রৈখিক সম্পর্ক।

এছাড়াও একটি খাদ্য শৃঙ্খল আরও দেখায় বিভিন্ন জীব খাদ্যের জন্য কীভাবে একে অপরের সাথে সম্পর্কযুক্ত। খাদ্য শৃঙ্খলের প্রতিটি স্তর একটি আলাদা ট্রফিক স্তর প্রতিনিধিত্ব করে। খাদ্য জাল থেকে খাদ্য শৃঙ্খল আলাদা। কারণ কোন বাস্তুতন্ত্রের বিভিন্ন প্রাণির মধ্যে খাদ্য-খাদকের সম্পর্কের জটিল নেটওয়ার্ক একত্রিত হয়ে খাদ্য জাল তৈরি হয়; অন্যদিকে খাদ্য শৃঙ্খল কেবল অল্প কয়েকটি জীবের মধ্যে খাদ-খাদকের একমূখী সম্পর্ক। অনেকগুলো খাদ্য শৃঙ্খলের মধ্যে প্রাকৃতিক আন্তঃসংযোগগুলো মিলে একটি খাদ্য জাল তৈরি হয়। অর্থাৎ, খাদ্য শৃঙ্খল হচ্ছে খাদ্য জালের একটি অংশ।

খাদ্য জালের ট্রফিক কাঠামোর পরিমাণের জন্য ব্যবহৃত একটি সাধারণ মেট্রিক হচ্ছে খাদ্য শৃঙ্খলের দৈর্ঘ্য। এর সরলতম রূপটিতে, একটি খাদ্য শৃঙ্খলের দৈর্ঘ্য হচ্ছে ট্রফিক খাদক এবং খাদ্য জালের ভিত্তির মধ্যে সংযোগের সংখ্যা। একটি সম্পূর্ণ খাদ্য জালের কোন খাদ্য শৃঙ্খলের গড় দৈর্ঘ্য হচ্ছে খাদ্য জালের অন্তর্ভুক্ত সব খাদ্য শৃঙ্খলের দৈর্ঘ্যের গাণিতিক গড়।

খাদ্যজাল (Food Web):

একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে খাদ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একাধিক খাদ্যশৃঙ্খলের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে যে আন্তঃসম্পর্ক গড়ে ওঠে তাকে খাদ্যজাল বলে। খাদ্যজাল একটি জটিল প্রক্রিয়া। খাদ্যজাল বহু খাদ্যশৃঙ্খলের সংযোগে তৈরী হওয়া একটি ছক যা প্রাকৃতিক ব্যবস্থায় ‘কে কি খায়’ তা সাধারণত চিত্রের আকারে তুলে ধরে। বাস্তুবিদ ও পরিবেশবিদরা সমস্ত জীবিত শরীরকে দুই ‘ট্রাফিক’ পর্যায়ে ভাগ করেছেন। যথা:

১)স্বয়ংসম্পূর্ণ জৈব শরীর বা autotroph- যারা নিজেদের খাদ্য স্বয়ং তৈরী করতে সক্ষম,

২)পর-নির্ভর জৈব শরীর বা heterotroph- যারা নিজেদের খাদ্য তৈরিতে অক্ষম ও পুষ্টি সংগ্রহের হেতু পর শরীরের ওপর নির্ভরশীল।

এরা সরাসরি বা পরোক্ষভাবে হলেও অটোট্রফদের ওপর নির্ভরশীল। সমস্ত প্রাণীর মতোই নিজেদের শরীরের স্বাভাবিক জৈবিক কার্য বজায় রাখতে, নিজেদের বৃদ্ধি, বিকাশে ও পুনরুৎপাদনের হেতু অটোট্রফরা অজৈবিক পদার্থসমূহ থেকে জৈবিক পদার্থ তৈরী করে। এইসব রাসায়নিক বিক্রিয়ার জন্য যা এনার্জি প্রয়োজন হয় তা প্রধানত সার্বজনীন প্রাণ ও শক্তিদাতা অর্থাৎ সূর্যের থেকেই আসে, যদিও জলাভূমিতে তার কিছুটা অংশ বায়োইলেট্রোজেনেসিস-এর ফলে ও হটস্প্রিং বা হাইড্রোথার্মাল ভেন্ট গুলিতে খনিজ ইলেকট্রন দানের ফলে তৈরির হয়।

সম্পূর্ণ অটোট্রফদের ও সম্পূর্ণ হেটেরোট্রফিদের মাঝখানের ভাগে মিক্সট্রপ (mixotroph) বলে একটি জাতির উদ্ভিদ প্রজাতি বিদ্যমান যারা সৌরশক্তির সাহায্যেও কিছু খাদ্য নির্মাণ করে ও কিছু অংশে পরশরীরের ওপর নির্ভরশীল, যেমন মাংসাশী গাছ বা “কার্নিভোরাস প্লান্ট”। একটি খাদ্যজালের বিভিন্ন খাদ্যশৃঙ্খলের সংযোগ বিভিন্ন খাদ্যপথ চিত্রায়িত করে, যেমন তৃণভোজী ও মাংশাসী হেটেরোট্রোফরা যথাক্রমে অটোট্রফ বা অন্য হেটেরোট্রোফদের ভক্ষণ করে জৈবিক পুষ্টি লাভ করে। একটি খাদ্যজাল অতি সহজভাবে বিভিন্ন খাদ্য পদ্ধতির সহজাত চিত্রায়ণ যা বাস্তুতন্ত্রকে একটি ঐক্যবদ্ধ বিনিময় ব্যবস্থার ছবি প্রদান করে।

আমাদের প্রকৃতিতে নানা প্রক্টরের খাদ্যাভ্যাস লক্ষ্য করা যায় যাদের ভেষজজীবী, মাংসাশী, মৃত শরীর থেকে পুষ্টি গ্রহণ বা স্ক্যাভেঞ্জারী,পরজীবীতা প্রমুখ বৃহৎ শ্রেণীতে ভাগ করা যায়। অটোট্রফ ও হেটেরোট্রোফরা বহু আকার ও রূপে পৃথিবীতে বিরাজমান_আণুবীক্ষণিক সায়ানোব্যাকটেরিয়া থেকে বিশালাকায় জায়ান্ট রেডউড ও ভাইরাস থেকে নিয়ে দৈত্যাকার ব্লু হোয়েল। এলটন-এর খাদ্যচক্রের ধারণা খাদ্যজালের ধারণায় রূপান্তরিত হয়।

খাদ্যশৃঙ্খল ও খাদ্যজালের মধ্যে পার্থক্যঃ

কোনো পরিবেশে অনেকগুলো খাদ্যশৃঙ্খল বিদ্যমান থাকতে পারে। এ খাদ্যশৃঙ্খলগুলো একটি অন্যটির সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। খাদ্যশৃঙ্খল ও খাদ্যজালের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-

১। সূর্যশক্তি খাদ্যের মাধ্যমে এক জীব হতে অপর জীবে স্থানান্তরের ফলে যে শৃঙ্খল গঠিত হয় তাকে খাদ্যশৃঙ্খল বলে। অন্যদিকে, একটি নির্দিষ্ট পরিবেশে খাদ্যের উপর ভিত্তি করে গড়ে ওঠা একাধিক খাদ্যশৃঙ্খলের মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতার ভিত্তিতে যে আন্তঃসম্পর্ক গড়ে ওঠে তাকে খাদ্যজাল বলে।

২। খাদ্যশৃঙ্খল বিভিন্ন উদ্ভিদ ও প্রাণীর মধ্যে পারস্পরিক নির্ভরশীলতাকে প্রকাশ করে। অন্যদিকে, খাদ্যজাল বিভিন্ন খাদ্যশৃঙ্খলের মধ্যে সম্পর্ক প্রকাশ করে।

৩। খাদ্যশৃঙ্খল একটি পরিবেশে কয়েকটি খাদ্যশৃঙ্খল থাকতে পারে। অন্যদিকে, একটি পরিবেশে একটি খাদ্যজাল থাকে।

৪। সবুজ উদ্ভিদ থেকেই প্রতিটি খাদ্যশৃঙ্খলের শুরু। অন্যদিকে, খাদ্যজালের শুরুর উপাদানটি নির্দিষ্ট নয়।

৫। খাদ্যশৃঙ্খলে খাদক উৎপাদক, বিয়োজক একসঙ্গে নাও থাকতে পারে। অন্যদিকে, খাদ্যজালে খাদক, উৎপাদক, বিয়োজক এক সঙ্গে থাকে।