বাস্তববাদের ও নব্য বাস্তববাদের মধ্যে পার্থক্য

বাস্তববাদ (Realism):

বাস্তববাদ বা রাজনৈতিক বাস্তববাদ হচ্ছে এই পাঠের প্রারম্ভ থেকে তৈরি হওয়া একটি প্রভাবশালী আন্তর্জাতিক সম্পর্ক তত্ত্ব। এই তত্ত্ব থুসিডাইডিস, ম্যাকিয়াভেলি ও হবস এর মত লেখকদের ধ্রুপদী চিন্তাধারার উপর নির্ভর করে। আন্তঃযুদ্ধ বছরগুলোর ভাববাদী চিন্তাধারার প্রতিক্রিয়া হিসেবে প্রারম্ভিক বাস্তববাদের উদ্ভব। জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বস্তুর স্বরূপ নির্ণয় করতে গিয়ে বাস্তববাদী দার্শনিকগণ বলেন, জ্ঞেয় বস্তুর মন নিরপেক্ষ স্বতন্ত্র অস্তিত্ব আছে, যা কোনভাবেই মনের উপর নির্ভরশীল নয়।

অর্থাৎ কোন বস্তু সম্পর্কে জ্ঞান অর্জন করার অর্থ এটা নয় যে, আমরা তাকে জানতে পারলাম বলেই তা সৃষ্টি হলো, বরং প্রকৃত সত্য হলো বস্তুটি পূর্বেই অস্তিত্বশীল ছিল। জ্ঞাতার ন্যায় জ্ঞেয় বস্তুরও স্বতন্ত্র অস্তিত্ব রয়েছে। তাই সকল বাস্তববাদী স্বীকার করেন যে, বস্তুর জ্ঞান নিরপেক্ষ বা মন নিরপেক্ষ নিজস্ব অস্তিত্ব রয়েছে, জ্ঞানের সাথে যার কোন অভ্যন্তরীণ সম্পর্ক নেই।

নব্য বাস্তববাদ (Neo-Realism):

নব্য বাস্তববাদ আন্তর্জাতি সম্পর্ক তত্বগুলোর মধ্যে একটি অন্যতম প্রধান তত্ত্ব। এই তত্ত্ব মূলত কেনেট ওয়ালটজ দিয়েছেন। নব্য বাস্তববাদ ধ্রুপদী স্তববাদের তত্বকে একটু ভিন্ন ভাবে দেখিয়েছে। নব্য বাস্তবাদের মতে আন্তজাতিক নৈরাজ্যের জন্য রাষ্ট্রগুলো দায়ী নয় বরং আন্তর্জাতিক কাঠামো দায়ী। এখনে রাষ্টগুলো একে অপরের সাথে প্রতিযোগিতা করে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির জন্য। আর আন্তর্জাতিক সিস্টেমটিতে কোন কেন্দ্রীয় শক্তি নেই যেকিনা রাষ্ট্রগুলোর আচরণকে নিয়ন্ত্রন করবে।

বাস্তববাদের ও নব্য বাস্তববাদের মধ্যে পার্থক্যঃ

বাস্তববাদ ও নব্য বাস্তববাদের মধ্যে বেশ কিছু পার্থক্য পরিলক্ষিত হয়। নিম্নে বাস্তববাদের ও নব্য বাস্তববাদের মধ্যে পার্থক্য নিয়ে আলোচনা করা হয়েছে-

১। বাস্তববাদীরা জ্ঞেয় বস্তুর মননিরেপেক্ষ অস্তিত্ব স্বীকার করেন। তাদের মতে, বস্তুর অস্তিত্ব মনের নিজস্ব কোনাে ভূমিকা নেই। অন্যদিকে, নব্য বাস্তববাদীর মনে করেন যে, জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব মন নিরপেক্ষ হলেও এখানে মনের গুরুত্ব রয়েছে। মনের ধারণার সঙ্গে অবিকল বা অনুরূপ তা আছে।

২। জ্ঞাতা সম্পর্কে বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, জ্ঞাতা বস্তুর অস্তিত্ব সম্পর্কে কোনাে প্রভাব ফেলতে পারে না। বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিদ্যমান। অন্যদিকে, নব্য বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, বস্তুর স্বতন্ত্র অস্তিত্ব বিদ্যমান থাকলে তা জ্ঞাতার মনের উপর প্রভাব বিস্তার করে।

৩। জ্ঞানের বিষয় সম্পর্কে বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, বস্তুর জ্ঞান মননিরপেক্ষ। মন নিরপেক্ষভাবে বস্তুর অস্তিত্ব বিদ্যমান। কারাে জানার উপর বস্তুর অস্তিত্ব নির্ভর করে না। অন্যদিকে, নব্য বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, জ্ঞানীয় সম্পর্কে সঙ্গে মত আবদ্ধ, কিন্তু আমাদের জ্ঞানের বস্তুর স্বরূপ নির্ভর করে না। বস্তুর সঙ্গে জ্ঞানের সম্পর্ক হচ্ছে বহিঃসম্পর্ক।

8। প্রত্যক্ষণ সম্পর্কে বাস্তববাদী দার্শনিকগণ মনে করেন যে, বস্তুর অস্তিত্ব মন নিরপেক্ষ। ইন্দ্রিয় দ্বারা এসব বস্তুর সাক্ষাৎ পরিচয় মেলে। অনুভবের মাধ্যমে বস্তুর ধর্মকে জানা যায়। মনের ধারণার সাথে বস্তুর ধারণার সাদৃশ্য বিদ্যমান। অন্যদিকে, নব্য বাস্তববাদীরা মনে করেন যে, বস্তুর সাথে আমাদের সম্পর্ক জ্ঞানীয়। জ্ঞানীয় সম্পর্কে আমরা বন্ধুর সাথে আবদ্ধ। আমাদের জ্ঞানের ওপর বস্তুর স্বরূপ নির্ভর করে না। প্রত্যক্ষণে প্রত্যক্ষণ কর্তা ও বস্তু থাকতেই হবে। বস্তুর সাথে জ্ঞানের সম্পর্ক হলাে বহিঃসম্পর্ক। প্রত্যক্ষণের একটি স্বতন্ত্র বস্তু থাকতে হবে।

৫। বাস্তববাদীদের মতে জ্ঞেয় বস্তুর অস্তিত্ব জ্ঞাতানির্ভর নয়। ইন্দ্রিয় দ্বারা জ্ঞতা জ্ঞেয় বন্ধুর সাক্ষাৎ পেয়ে থাকে। আবার বিজ্ঞানসম্মত বাস্তববাদ বস্তুর সাক্ষাৎ অনুভব স্বীকার করেন না। তাদের মতে, বস্তুকে সাক্ষাতভাবে জানা যায়, তা হলাে বস্তুর প্রতিফলন। অন্যদিকে, নব্য বাস্তববাদীদের মতে, জ্ঞাতা ও জ্ঞেয় বিষয়ের মধ্যে সম্পর্ক হলাে বাইরের সম্পর্ক। এ সম্বন্ধ স্থাপনে কারও কোনাে পরিবর্তন হয় না।