গ্রামীণ ও নগর সমাজের মধ্যে পার্থক্য

গ্রামীণ সমাজ(Rural Society):

বৈশিষ্ট্যগত কারণেই গ্রামীণ সমাজ অন্য যেকোনো সমাজ থেকে আলাদা। বাংলাদেশ তথা ভারতীয় উপমহাদেশ প্রধানত গ্রামনির্ভর জনপদ। যুগ যুগ ধরে এখানে গ্রাম-সমাজ টিকে ছিলো অপরিবর্তিত রূপে। গ্রামীণ সমাজের মূল ভিত্তি ছিল স্বয়ংসম্পূর্ণ গ্রামীণ সম্প্রদায়। গ্রামের মানুষ তাদের প্রয়োজনীয় সব উপকরণ নিজেরাই উৎপাদন করতো। ফলে বাইরের গ্রাম বা শহরের সাথে তাদের যোগাযোগ ছিল খুবই সীমিত। গ্রামীণ সমাজ বলতে মূলত কৃষিকাজ ও কৃষক সমাজ নিয়ে গঠিত জনপদকে বুঝায়। চাষযোগ্য জমি, কৃষকের উঠান, লাঙ্গল-জোয়ালসহ চাষীর মাঠে গমন, আঁকা-বাঁকা কাঁচা সড়ক কিংবা ছোট নদী আর গাছ-গাছালি, স্নেহ-ছায়া ও পাখ-পাখালির কল-কূজনে মুখরিত গুচ্ছ গুচ্ছ বাড়ি ঘর নিয়ে গ্রাম গড়ে ওঠে। এ গ্রামের আদিবাসীরা যে আথর্- সামাজিক ব্যবস্থা গড়ে তোলে তা-ই মূলত গ্রামীণ সমাজ। গ্রামে শহরের তুলনায় জনবসতির ঘনত্ব কম।
Nelson তাঁর Rural Sociology গ্রন্থে বলেছেন, “পরিসংখ্যানগত দিক থেকে গ্রাম হচ্ছে সে জনপদ যার জনসংখ্যা ২৫০০ জনের কম।”

নগর সমাজ(Urban Society):

‘নগর’ এর ইংরেজি প্রতিশব্দ হিসেবে Urban, City, Town ইত্যাদি প্রচলিত। পাকা ভবন, প্রশস্ত পাকা রাস্তা, মানুষের কোলাহল, যন্ত্র নির্ভর গতিশীল জীবন নিয়ে গড়ে উঠে নগর। কোনো জনপদকে নগর, শহর বা পৌর অঞ্চল হিসেবে স্বীকৃতি পেতে হলে সেখানে উচ্চমাত্রার জনসংখ্যা এবং কৃষি বহির্ভুত পেশার আধিক্য থাকতে হয়।

সমাজবিজ্ঞানী Dr. William Munro বলেছেন, বিপুল জনগোষ্ঠী, স্বল্প পরিসরের মধ্যে অসংখ্য বাসস্থান, স্বায়ত্তসাশিত পৌর কতৃর্প ক্ষ, নানাবিধ অর্থনৈতিক প্রতিষ্ঠান এবং জীবিকার তাগিদে ছুটে চলা মানুেষর ব্যস্ত জীবন নিয়ে গড়ে ওঠে নগর সমাজ।
Louis Wirthএর মতে, নগর হল সামাজিক দিক হতে বৈসাদৃশ্যপূর্ণ মানুষের তুলনামূলকভাবে বড়, ঘন এবং স্থায়ী বাসস্থানের অঞ্চল।
Alvin Boskoff নগর সমাজের কয়েকটি বৈশিষ্ট্যের উল্লেখ করেছেন। এগুলো হচ্ছে: ক) শিল্প-বাণিজ্য এবং বৃত্তি সম্পর্কীয় অকৃষি পেশার আধিক্য, খ) নিয়মতান্ত্রিক শ্রমবিভাজন, গ) জনসখ্যার অত্যধিক ঘনত্ব এবং ঘ) জ্ঞাতি সম্পর্কের বন্ধনহীন সামাজিক নিয়ন্ত্রণ।

গ্রামীণ ও নগর সমাজের মধ্যে পার্থক্যঃ

বিভিন্ন ক্ষেত্রে সাদৃশ্য থাকলেও গ্রামীণ ও নগর সমাজের মধ্যে মৌলিক পার্থক্য পার্থক্য বিদ্যমান। গ্রামীণ ও নগর সমাজের
বৈসাদৃশ্য বাহ্যিকভাবে পরিলক্ষিত হয়-

১। গ্রামীণ সমাজ কৃষিভিত্তিক। অন্যদিকে নগর সমাজ শিল্পোৎপাদন ও সেবাভিত্তিক।

২। গ্রামীণ সমাজের সংস্কৃতি সনাতন ও ঐতিহ্যবাহী। অন্যদিকে নগর সমাজ অগ্রসরমান ও আধুনিক।

৩। গ্রামীণ সমাজে নির্দিষ্ট জনসংখ্যার বাধ্যবাধকতা নেই। একটি গ্রামে সাধারণত এক থেকে দশ হাজার মানুেষর বসবাস।
অন্যদিকে একটি জনপদকে শহর হতে হলে কমপক্ষে ৫০ হাজার মানুষ বসবাস করতে হয়। কোনো কোনো মেগাশহরে এক কোটির অধিক মানুষ বসবাস করে।

৪। গ্রামে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক কম। অন্যদিকে শহরে জনসংখ্যার ঘনত্ব অনেক বেশি।

৫। গ্রামীণ সমাজে বসতবাড়ি ও জলাশয় ব্যতীত অধিকাংশ ভুমি কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত হয়। অন্যদিকে শহরে কৃষি ভুমি নেই বললেই চলে।

৬। গ্রামীণ সমাজে মানুষের পেশা কৃষি, ক্ষুদ্র ব্যবসা, দিনমজুরি ও স্থানীয় পেশাভিত্তিক জনগোষ্ঠী। অন্যদিকে নগর সমাজ কৃষি বহির্ভুত শিল্পোৎপাদন ও সেবাভিত্তক পেশার আধিক্য।

৭। গ্রামীণ সমাজে শিক্ষার হার কম, উচ্চশিক্ষিত মানুষ খুব কমই গ্রামে বসবাস করেন। অন্যদিকে নগর সমাজে শিক্ষার হার অপেক্ষাকৃত বেশি। শহরে অনেক শিক্ষিত এবং উচ্চশিক্ষিত মানুষ বসবাস করেন।

৮। গ্রামীণ সমাজে নাগরিক সুযোগসুবিধা গ্যাস, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ প্রভৃতি সুযোগ-সুবিধা তুলনামূলকভাবে কম। অন্যদিকে নগর সমাজে গ্যাস, বিদ্যুৎ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পয়ঃনিষ্কাশনসহ নাগরিক সুেযাগ-সুবিধা অনেক বেশি এবং উন্নত।

৯। গ্রামীণ সমাজে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, প্রথা ও মূল্যবোধের ভিত্তিতে সামাজিক নিয়ন্ত্রণ হয়। অন্যদিকে নগর সমাজে আইন এবং বিধিবদ্ধ প্রতিষ্ঠান মূখ্য ভুমিকা পালন করে।

১০। গ্রামীণ সমাজের ক্ষমতা কাঠামো কৃষি জমি, বৃহৎ জ্ঞাতি-গোষ্ঠী, বংশ মর্যাদা ইত্যাদি সনাতন উপাদানের অস্তিত্ব লক্ষণীয়। অন্যদিকে নগর সমাজের কর্তৃত্বপূর্ণ পেশা, শিক্ষা, নগদ অর্থ, বিলাসবহুল বাড়ি-গাড়ি, শিল্প ও বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের মালিকানা, রাজনৈতিক প্রভাব প্রভৃতি উপাদানের দৃঢ় ভুমিকা রয়েছে।