আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসার মধ্যে পার্থক্য

আলিয়া মাদ্রাসা (Alia Madrasa):
ইসলামি শিক্ষা চালু রাখার জন্য মুসলিম শিক্ষাবিদরা তৎকালীন ভারতের প্রথম ইংরেজ গভর্নর জেনারেল ওয়ারেন হেস্টিংসের কাছে একটি ইসলামি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান মাদরাসা প্রতিষ্ঠার দাবি জানান। প্রথমে গভর্নর রাজি না হলেই কিছু ধর্মানুরাগী শিক্ষাবিদগণের চাপে তিনি রাজি হন। তবে এই প্রতিষ্ঠানে ইংরেজ শিক্ষক নিয়োগ, কুরআন, হাদিস ও ফিকহের সিলেবাস সংক্ষিপ্তকরণের মত কিছু শর্ত চাপিয়ে দেওয়া হয়।

১৭৮০ সালে ওয়ারেন হেস্টিংসের নির্দেশে কলকাতার শিয়ালদাহের নিকটস্থ বউবাজার অঞ্চলে মোল্লা মাজদুদ্দিনকে হেড মাওলানা নিয়োগ দিয়ে ৪০ জন ছাত্র নিয়ে কলকাতা মাদ্রাসার সূত্রপাত হয় (এই আলিয়া মাদ্রাসাকে ২০০৮ সালে আলিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ে উন্নিত করা হয়েছে)। এই মাদ্রাসা থেকেই আলিয়া মাদ্রাসার উৎপত্তি।

কওমি মাদ্রাসা (Qawmi Madrasa):
১৮৫৭ সালের সিপাহি বিদ্রোহের বিষয়ে ইংরেজ সরকার মুসলিমদের অভিযোগ করে, সাথে সাথে দিল্লিসহ সারা ভারতে প্রায় ৩৩ হাজার আলেম দণ্ডিত করে ও প্রকাশ্যে ফাঁসিতে ঝোলায়। ভারতবর্ষের মুসলমানদের রাজনৈতিক ক্ষমতা ও আর্থিক সম্পত্তি দখল করে নেয়, ইসলামি শিক্ষাকে বাধাগ্রস্থ করে। এভাবে মুসলিমদের পরিস্থিতি ক্রমান্বয়ে খারাপ হতে থাকে। তখন মুহাম্মদ কাসেম নানুতুবিসহ কিছু আলেম বেসরকারি মাদ্রাসা প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেয়, যাতে সরকার এই সকল মাদ্রাসার উপর হস্তক্ষেপ না করতে পারে।

১৮৬৬ সালে সাহারানপুর জেলার দেওবন্দ নামক স্থানে কাসেম নানুতুবি ও সৈয়দ আবিদ হোসাইন দারুল উলুম দেওবন্দ নামে একটি কওমি মাদরাসা প্রতিষ্ঠিত করে। তবে আকাবিরে সিত্তাহ নামে ছয়জন ব্যক্তি এই মাদ্রাসাটি প্রতিষ্ঠা করেন। এই ধরনের মাদ্রাসায় সরকার থেকে রাষ্ট্রীয় অনুদান, বেতনভাতা ও অবকাঠামোগত সুবিধা নেওয়া হয় না, বরং জনগণের দানের টাকায় এটি পরিচালিত হয়। এই মাদ্রাসা থেকেই কওমি মাদ্রাসার উৎপত্তি।

কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ১০ বছরের পড়ালেখায় ছয়টি ধাপ রয়েছে। তবে পূর্বে কওমি মাদ্রাসার কোন সরকারি স্বীকৃতি ছিলোনা, এসব মাদ্রাসা অনেক বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হলেও তৃতীয়াংশ মাদ্রাসা বেফাকুল মাদারিসিল আরাবিয়া বাংলাদেশ শিক্ষা বোর্ডের অধীনে পরিচালিত হয়। ২০১৭ সালে সরকার কওমি মাদ্রাসার দাওরায়ে হাদিসকে স্নাতকোত্তর (মাস্টার্স) সমমানের স্বীকৃতি দিয়ে আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ নামে পৃথক বোর্ড গঠন করে দেয় শুধু দাওরায়ে হাদিসের জন্য। দাওরায়ে হাদিসে এসে সব বোর্ডের পরিক্ষার্থীগণই আল হাইআতুল উলয়া লিল জামিআতিল কওমিয়া বাংলাদেশ এর অধীনে পরিক্ষা দেন।

আলিয়া ও কওমি মাদ্রাসার মধ্যে পার্থক্যঃ

১। আলিয়া মাদ্রাসার শিক্ষা ব্যবস্থায় ইবতেদায়ী থেকে কামিল শ্রেণী পর্যন্ত ১৬ বছরের পড়ালেখায় পাঁচটি ধাপ রয়েছে। অন্যদিকে, কওমি মাদ্রাসা শিক্ষা ব্যবস্থায় ১০ বছরের পড়ালেখায় ছয়টি ধাপ রয়েছে।

২। আলিয়া মাদ্রাসার ইতবেদায়ী স্তরে (প্রাথমিক শিক্ষা) কুরআন ও হাদিস শিক্ষা, আকাইদ ও ফিকহ শিক্ষা ও আরবি ভাষা শিক্ষা প্রদান করা হয়। এছাড়াও এই স্তরে বাংলা, গণিত, ইতিহাস, ভূগোল ও সাধারণ বিজ্ঞান শিক্ষা প্রদান করা হয়।

অন্যদিকে, কওমি মাদ্রাসার প্রাক-প্রাথমিক স্তরকে মক্তব বলা হয়, এই স্তরে কুরআন পড়তে শেখানো হয়। পরবর্তীতে সাথে সাথে কুরআন মুখস্ত করানো হয়, এই ধরনের মাদ্রাসাকে হাফেজিয়া মাদ্রাসা বলা হয়।

৩। আলিয়া মাদ্রাসার দাখিল (মাধ্যমিক) স্তরে শিক্ষার্থীদের জন্য কুরআন অধ্যয়ন ও মুখস্তের পাশাপাশি কুরআনের বিভিন্ন আয়াতের ব্যাখ্যা ও তাফসির পড়ানো হয়। হাদিসের বর্ণনা ও ব্যাখ্যা পড়ানো হয়। এগুলোর পাশাপাশি আরবি ভাষা, ইসলামি দর্শন, ইসলামি আইন পড়ানো হয়। এবং দাখিল স্তরের ক্লাস নাইনে বিজ্ঞান বা মানবিক বিভাগ নির্বাচনের সুযোগ আছে। বিজ্ঞানের শিক্ষার্থীরা পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গনিত পড়ে থাকে। এর বিপরীতে মানবিকের শিক্ষার্থীরা ইসলামের ইতিহাস, পৌরনীতি ও অর্থনীতি পড়ে থাকে।

অন্যদিকে, কওমি মাদ্রাসার দ্বিতীয় স্তরে রয়েছে ইবতেদায়ী, এখানে প্রাথমিকভাবে শিক্ষার্থীদের আরবি, উর্দু ও ফার্সি ভাষা পড়তে ও লিখতে শেখানো হয়। এটিই মূলত কওমি মাদ্রাসার প্রথম স্তর। এখানে শিক্ষার্থীদের কিছু বাংলা, ইংরেজি ও গণিতও শেখানো হয়।

৪। আলিয়া মাদ্রাসার আলিম (উচ্চ মাধ্যমিক) স্তরের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান বা কলা বিভাগকে বেছে নিতে হয়। উভয় বিভাগের শিক্ষার্থীরা কুরআন ও হাদিস, ইসলামি আইন, শরিয়া আইন ও আরবি ভাষা পড়তে হয়। এবং বিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষার্থীদের পদার্থ, রসায়ন, জীববিজ্ঞান ও উচ্চতর গনিত পড়তে হয়। আর মানবিকের শিক্ষার্থীদের উত্তরাধিকার আইন ও ইসলামের ইতিহাস ও বালাগাত-মানতিক পড়তে হয়।

অন্যদিকে, কওমি মাদ্রাসার তৃতীয় স্তরে রয়েছে মুতাওয়াসিত্তাহ পরীক্ষা। কওমি মাদ্রাসায় ১০ বছর পড়াশোনা পর মাধ্যমিক সমতুল্য এই পরীক্ষা দিতে হয়। এটাকে আলিয়া মাদ্রাসার দাখিল পরীক্ষার সমতুল্য বলা যেতে পারে।

৫। আলিয়া মাদ্রাসার ফাজিল শ্রেণীতে (স্নাতক পর্যায়) শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান ও কলা বিভাগের বিষয়গুলো আলাদা আলাদা করে শেখানো হয়। অন্যদিকে, কওমি মাদ্রাসার মুতাওয়াসিত্তাহ পরীক্ষার পর দুই বছর শিক্ষার্থীদের কুরআন, হাদিস, ইসলামি আইন, ইসলামি দর্শন ও ইসলামের ইতিহাস পড়তে হয়। এটাকে আলিয়া মাদ্রাসার আলিম পরীক্ষার (উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা) সমতুল্য বলা যেতে পারে।

৬। আলিয়া মাদ্রাসার কামিল শ্রেণীতে (স্নাতকোত্তর পর্যায়) শিক্ষার্থীদের শুধু ধর্ম বিষয়ে পড়ানো হয়। এই পর্যায়ে এসে তাদের হাদিস, তাফসির (কোরআনের ব্যাখ্যা), ইসলামি আইন ও আরবি সাহিত্য বিশেষায়িতভাবে পড়ানো হয়।

অন্যদিকে, কওমি মাদ্রাসায় এরপর দাওরায়ে হাদিস নামে দুই বছর মেয়াদি কোর্স রয়েছে। এই কোর্সে বুখারি শরীফ, মুসলিম শরীফসহ হাদিসের অন্যান্য বই পড়ানো হয়। এই পরীক্ষাকে আলিয়া মাদ্রাসার কামিল পরীক্ষার সাথে তুলনা করা যায়।