ছানা এবং পনিরের মধ্যে পার্থক্য

ছানা (Chhena):
ছানা হলো দুধ থেকে তৈরি একটি বিশেষ খাদ্য দ্রব্য। ছানাকে সংস্কৃত ভাষায় বলা হয় তক্রপিণ্ড বা তক্র কুর্চিকা। অনেকেই হয়তো জানেন না, ছানার পানিতেও থাকে অনেক রকম পুষ্টিকর উপাদান। ছানার পানিকে তুলনা করা যায় অনেকটা ভাতের মাড়ের সঙ্গে। ভাত রান্নার পর ভাতের মাড়কে পুষ্টিকর জেনেও যেমন আমরা ফেলে দিই, তেমনি অবস্থা এই ছানার পনির। দুটিরই শেষ গন্তব্য নর্দমা। ভাবতে খারাপ লাগে যে পুষ্টিজ্ঞানের অভাবে ছানার পানির পুষ্টিকে আমরা কাজে লাগাতে পারি না। অথচ ছানার পানির রয়েছে পুষ্টি পূরণের ক্ষমতা। পুষ্টিবিজ্ঞানীদের কাছে ছানার পরিচয় কেজিন নামে একটি প্রোটিন হিসেবে। সাধারণের কাছে এটি পরিচিত সন্দেশ, রসগোল্লার মতো মিষ্টিজাতীয় খাবারের প্রধান উপকরণ হিসেবে।

ছানার প্রস্তুত প্রণালী:
সিরকার সঙ্গে সমপরিমাণ জল যুক্ত করা হয়। দুধ উননে ফোটানো হয়। ফুটে উঠা মাত্রই সিরকা দিয়ে আগুন থেকে নামিয়ে ঠাণ্ডা করে ফেলা হয়। দুধের ছানা ও পানি আলাদা হলে সঙ্গে সঙ্গে দুধ একটি কাপড় বা ছাকনিতে ঢেলে খোলা বাতাসে ৬-৭ ঘণ্টা রাখা হয়। পানি ঝরে গেলে ছানা ঠাণ্ডা জায়গায় রাখা হয়। ছানা দিয়ে সন্দেশ, মিষ্টি, রসগোল্লা ইত্যাদি তৈরি হয়। এক লিটার দুধ থেকে আধা কাপ ছানা পাওয়া যায়। ছানা দিয়ে পনিরও তৈরি করতে পারেন।

পনির (Paneer):
পনির হল দক্ষিণ এশিয়ায় প্রচলিত ছানা থেকে তৈরি একটি দুগ্ধজাত খাদ্য। সাধারণত ফুটন্ত দুধে লেবুর রস, ভিনেগার অথবা অম্লজাতীয় কোন পদার্থ যোগ করে ছানা তৈরি করা হয় এবং সেই ছানা থেকে পানি বের করে দিয়ে পনির প্রস্তুত করা হয়ে থাকে। পনির হল একটি দুগ্ধজাত পণ্য যা দুধের প্রোটিন কেসিনের জমাট বাঁধার মাধ্যমে বিস্তৃত স্বাদ, টেক্সচার এবং আকারে উৎপাদিত হয়। এটি দুধ থেকে প্রোটিন এবং চর্বি নিয়ে গঠিত, সাধারণত গরু, মহিষ, ছাগল বা ভেড়ার দুধ। উৎপাদনের সময়, দুধ সাধারণত অম্লীয় হয় এবং একই ধরনের কার্যকলাপ সহ রেনেট বা ব্যাকটেরিয়াল এনজাইমের এনজাইম যোগ করা হয় যাতে ক্যাসিন জমাট বাঁধতে থাকে। তারপর শক্ত দইগুলোকে তরল ছাই থেকে আলাদা করে তৈরি করা পনিরে চাপানো হয়। কিছু পনিরের ছাঁচে, বাইরের স্তরে বা জুড়ে সুগন্ধযুক্ত ছাঁচ থাকে।

পনির প্রস্তুত প্রণালী:
পনির প্রস্তুত করার জন্য প্রথমে ফুটন্ত দুধে অম্লজাতীয় পদার্থ যেমন, লেবুর রস অথবা ভিনিগার মিশিয়ে দেওয়া হয়। এর ফলে দুধ থেকে ছানা এবং পানি আলাদা হয়ে যায়। এরপর একটি শুকনো কাপড়ে ছানা ছেঁকে অতিরিক্ত পানি বের করে দেওয়া হয়। পরে ছানার মণ্ডটিকে ঠান্ডা পানিতে ২-৩ ঘণ্টা ডুবিয়ে রাখা হয়। অধিকাংশ রন্ধনশৈলীতেই পানি ঝরানোর সময় শুকনো কাপড়ে জড়ানো ছানার মণ্ডটিকে কোন ভারী ওজনের তলায় চেপে রাখা হয় এবং পানি ঝরে যাওয়ার পরে মণ্ডটিকে ঘনক আকারে কাটা হয়। প্রায় ২০ মিনিট কোন ভারী ওজনের তলায় চেপে রাখলে পনির নরম থাকে।

ছানা এবং পনিরের মধ্যে পার্থক্যঃ

ছানা ও পনির দুটি দুধ দিয়ে তৈরি হলেও প্রস্তুত প্রণালীর ক্ষেত্রে ভিন্নতা রয়েছে। তাই নিচে ছানা এবং পনিরের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে-

১. ফুটন্ত গরম দুধে এডিবল অ্যাসিডিক উপাদান (যেমন লেবুর রস বা ভিনেগার) দিলে দুধ কেটে ছানা তৈরি হয়। এটা ছানার প্রাথমিক পর্যায়। সেই ছানা পরে ভালো করে ছেঁকে, ধুয়ে নিলে খাওয়ার জন্য প্রস্তুত হয়ে যায়।

অন্যদিকে, পনির করতে গেলে এই প্রসেসড ছানায় প্রয়োজন মতো নুন মেশাতে হয়। তারপর সেটা পাতলা কাপড়ে পেঁচিয়ে ভারী কিছু দিয়ে চাপা দিয়ে কয়েক ঘন্টা রাখতে হয় । এটা পরে শক্ত হয়ে পনিরে রূপ নেয়৷

২. দুধ কেটে ছানা হওয়ার পরে সেটা বরফ ঠান্ডা পানি দিয়ে নিচে ধুয়ে নিতে হয়। এতে ছানা জমে যাওয়ার আশঙ্কা থাকেনা। অন্যদিকে, পনির বানানোর সময় পানির কোন ব্যবহার হয় না।

৩. ছানায় প্রোটিন, কার্ব, এবং ফ্যাটের পরিমাণ বেশি থাকে। অন্যদিকে, পনিরের প্রোটিনের পরিমাণ ছানার তুলনায় কম থাকে।

৪. ছানা প্রধানত মিষ্টি বানাতে, বিশেষ করে বাঙালি মিষ্টি খাবার তৈরিতে ব্যবহৃত হয়। তরকারিতে এর ব্যবহার কম। অন্যদিকে, পনির দিয়ে ঝাল-মশলার তরকারি তৈরি করা যায়। বিশেষ করে যারা নিরামিষ খান।

৫. ছানা দেখতে পাউডারের মত, তবে প্রথম অবস্থায় ছোবড়া ছোবড়া লাগে। তাই অনেকে ছানাকে ‘ক্রাম্বলড পনির’ বলে থাকেন। অন্যদিকে, পনির শক্ত থাকে। ছানাকে মুঠো করে বলের মতো বানানো যায়। পনির যেহেতু শক্ত তাই এটাকে ত্রিভুজাকৃতির করে কেটে নেয়া যায়৷

৬. ছানায় ময়েশ্চার থাকে, তাই এটা মসৃণ এবং নরম। এটা সফট চিজ নামেও পরিচিত। অন্যদিকে, পনিরে ময়েশ্চার থাকেনা বা থাকলেও তুলনামূলকভাবে অনেক কম। তাই পনীরের টেক্সচার রুক্ষ হয়।

৭. ছানা থেকে যে পানি বের হয় সেটাকে মাঠা বা ঘোল বলে। অন্যদিকে, পনিরের থেকে পানি সম্পূর্ণভাবে বের করে ফেলা হয় চাপ প্রয়োগের মাধ্যমে। ছানার পানি বাহির করতেও বেশি সময় লাগেনা। কিন্তু পনিরের পানি বাহির করতে কয়েক ঘন্টা সময় লেগে যায়।

৮. ছানা তৈরির জন্য গরুর দুধ হচ্ছে অন্যতম উপাদান। গরুর দুধ থেকে তৈরি ছানা বেশ সফট আর স্মুদ হয়। আর এটা দিয়ে মিষ্টি বানালে কোয়ালিটিও ঠিক থাকে। মহিষের দুধ দিয়ে বানানো ছানা কিছুটা শক্ত এবং অমসৃণ টেক্সচারের হয়। এই ছানার মিষ্টি খেতে খুব একটা ভালো লাগে না। অন্যদিকে, পনির বানাতে বেশি সময় লাগে। তবে পনির গরু এবং মহিষ উভয়ের দুধ থেকেই বানানো যায়।