ফাংশনাল ফুড ও ফুড সাপ্লিমেন্ট’য়ের মধ্যে পার্থক্য

ফাংশনাল ফুড (Functional Food):
সুস্থ শরীর, প্রশান্ত মন ভালো থাকার প্রধান শর্ত। শরীর সুস্থ রাখার উপায় নিয়ে যুগে যুগে সারাবিশ্বে নানামুখী গবেষণা হয়েছে। সঠিক খাদ্যাভ্যাস আর শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যাপারে প্রায় সব চিকিৎসা তত্ত্বেই জোর দেওয়া হয়েছে। কেননা শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা শক্তিশালী না হলে সামান্য অসুখেই মানুষ দুর্বল হয়ে পড়তে পারে এবং জটিল সমস্যার মুখোমুখি হতে পারে। সুস্বাস্থ্যের জন্য পুষ্টির তাৎপর্য উপলব্ধি করে আধুনিক চিকিৎসা বিজ্ঞানের জনক হিপোক্রেটস বলেছেন, ‘খাদ্যকে ওষুধ হতে দিন আর ওষুধকে খাদ্য।’ এশিয়া বিশেষ করে ভারতবর্ষ, জাপান এবং চীন অনেক বছর ধরেই বিভিন্ন রোগ-ব্যাধি প্রতিরোধ, প্রশমন এবং নিরাময়ে বিশেষ ধরনের খাবারকে তাদের স্বাস্থ্য সুরক্ষার অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে ব্যবহার করে আসছে। সুস্থ জীবনযাপনে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি ও জটিল স্বাস্থ্যঝুঁকি হ্রাসের লক্ষ্যে আশির দশকে জাপানে প্রথম ‘ফাংশনাল ফুড’-এর ধারণা উদ্ভূত হয় এবং ১৯৯১ সালে এটি জাপানে আইনি ভিত্তি পায়। বাংলাদেশে জাতীয় সংসদ ২০১৩ সালে ‘নিরাপদ খাদ্য আইন ২০১৩’ পাস করে, যেখানে ৩১ নং ধারার অধীনে ‘ফাংশনাল ফুড’ অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।

ফাংশনাল ফুড বলতে মূলত প্রাকৃতিক ও নিরাপদ খাদ্যকে বোঝায়, যা আমাদের মৌলিক পুষ্টি চাহিদার ঊর্ধ্বে গিয়ে শরীরের একাধিক কার্যকারিতায় ভূমিকা রাখে এবং বিশেষ কিছু রোগ ও অন্যান্য স্বাস্থ্যঝুঁকি কমাতে সহায়তা করে। ফাংশনাল ফুড বিভিন্ন বায়ো-অ্যাকটিভ উপাদানের মাধ্যমে শরীরে কার্যকর প্রভাব ফেলে। হলুদ, গোলমরিচ, আদা, মধু, অ্যাপেল সাইডার ভিনেগার, চিয়াসিড, কাজুবাদাম, দারুচিনি ইত্যাদি ফাংশনাল ফুড হিসেবে পরিচিত। এগুলোর মধ্যে হলুদের অন্যতম সক্রিয় উপাদান কারকিউমিন হৃদরোগ, আলঝেইমার ও ক্যান্সার প্রতিরোধে অত্যন্ত উপকারী। পেটের অসুখ, মাথাব্যথা ও ইনফেকশন সারাতে বহু বছর ধরেই ব্যবহৃত হয়ে আসছে আদা। স্বাদবর্ধক গোলমরিচে রয়েছে পিপেরিন নামের একটি বিশেষ উপাদান, যা স্কিন ক্যান্সার প্রতিরোধে সাহায্য করে ও ব্রেনের বেটা-এন্ডরফিন্স বৃদ্ধি করে। এন্ডরফিন্স প্রাকৃতিক ব্যথানাশক হিসেবে কাজ করতে পারে। এছাড়া গোলমরিচ সেরেটোনিন বৃদ্ধির মাধ্যমে ডিপ্রেশন কমাতেও কার্যকর ভূমিকা রাখে। বর্তমানে ইউরোপ, আমেরিকাসহ পৃথিবীর উন্নত প্রযুক্তি নির্ভর দেশেও মানুষ বায়ো-অ্যাকটিভসমৃদ্ধ খাদ্যের মাধ্যমে স্বাস্থ্যঝুঁকি কমানোর ব্যাপারে বিশেষ আগ্রহী হয়ে উঠেছে।

ফুড সাপ্লিমেন্ট (Food Supplement):
ফুড সাপ্লিমেন্ট পুষ্টি উপাদানের আধিক্য ঘটিয়ে কৃত্রিমভাবে তৈরি করা হয়। এক বা একাধিক পুষ্টি উপাদানের ঘাটতি পূরণে এগুলো ডোজ আকারে, যেমন—বড়ি, ট্যাবলেট, পাউডার, ক্যাপসুল বা তরলভাবে বাজারজাত করা হয়। ফুড সাপ্লিমেন্ট পুষ্টির ঘাটতি সংশোধন করার উদ্দেশ্যে, নির্দিষ্ট পুষ্টির পর্যাপ্ত গ্রহণ বজায় রাখতে বা নির্দিষ্ট শারীরবৃত্তীয় ক্রিয়াকলাপ ঠিক রাখার উদ্দেশ্যে ব্যবহার করা হয়। এগুলো ঔষধি পণ্য নয়, এগুলো মানুষের রোগের প্রতিরোধ বা শারীরবৃত্তীয় ফাংশন সংশোধন করার জন্য ব্যবহার করা হয়।

একজন রোগী যখন চিকিৎসকের বা পুষ্টিবিদের কাছে আসে, তখন প্রাকৃতিক খাদ্য দিয়ে তার শরীরের চাহিদা পূরণ করার চেষ্টা করা হয়। এর পরও যখন কোনোভাবেই রোগীর খাদ্য দিয়ে ঘাটতি পূরণ করা সম্ভব হয় না, তখন ফুড সাপ্লিমেন্টের কথা চিন্তা করা হয়। পরীক্ষা-নিরীক্ষা করেই ফুড সাপ্লিমেন্টের ডোজ ঠিক করা হয়।

ফাংশনাল ফুড ও ফুড সাপ্লিমেন্ট’য়ের মধ্যে পার্থক্যঃ
‘ফাংশনাল ফুড’ এবং ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ দুটি খাবারের মধ্যে পার্থক্য এবং সামান্য সামান্য সাম্য নিম্নলিখিত উপায়ে লিখা যেতে পারে। তা নিচে দেখানো হয়েছে-

১. ‘ফাংশনাল ফুড’ একটি প্রাকৃতিক খাবার, যা সাধারণভাবে পোষণের দিকে বেশি গুরুত্ব দেয়। এই খাবারে বিশেষ গুণগুলি থাকতে পারে, যা স্বাস্থ্যের জন্য উপকারি হতে পারে। অন্যদিকে, ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ হলো এমন প্রোডাক্ট, যা খাবারের পোষণগুণগুলি অথবা বিশেষ যোগকের একটি সূক্ষ্ম পরিমাণ সরবরাহ করে। এই সাপ্লিমেন্টগুলি সাধারণভাবে পোষণ বা নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যে নেওয়া হয়।

২. ‘ফাংশনাল ফুড’ এর উদ্দেশ্য সাধারণভাবে পোষণ এবং স্বাস্থ্য সমর্থন করা, যাতে মানুষের সাধারণ স্বাস্থ্য উন্নত হতে পারে। অন্যদিকে, ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ হলো সংকৃতি বা অভাবের মুখোমুখি প্রশ্নে একটি সমাধান, যেখানে নির্দিষ্ট পোষণ অথবা উদ্দেশ্যের জন্য যোগ করা হয়, উদাহরণস্বরূপ, আয়রন বা ভিটামিন সাপ্লিমেন্টগুলি।

৩. ‘ফাংশনাল ফুড’ এর উপাদান সাধারণভাবে প্রাকৃতিক খাবার যেমন ফল, সবজি, দানা, দুগ্ধ, প্রোটিন, ফাইবার, মিনারেল, ভিটামিন ইত্যাদি যা স্বাভাবিক ভাবে খেয়া হয়। অন্যদিকে, ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ এর উপাদান সাধারণভাবে সঙ্গতির জন্য ডিজাইন করা হয়, যেমন আয়রন সাপ্লিমেন্ট বা ভিটামিন ট্যাবলেট ইত্যাদি।

৪.’ফাংশনাল ফুড’ সাধারণভাবে প্রতিদিনের খাবারের একটি অংশ হিসেবে ব্যবহার করা হয় এবং স্বাস্থ্য উন্নত করতে সাহায্য করতে পারে। অন্যদিকে, ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ সাধারণভাবে ডাক্তারের পরামর্শ অনুসরণ করে নেওয়া হয়, যেখানে নির্দিষ্ট পোষণের অথবা উদ্দেশ্যের জন্য সাপ্লিমেন্টগুলি নির্ধারণ করা হয়।

৫. ‘ফাংশনাল ফুড’ এর সাধারণভাবে কোনও বেশি সাইড ইফেক্ট নেই, যদিও কিছু ব্যক্তিগত সমস্যার কারনে ইফেক্ট করতে পারে। অন্যদিকে, ‘ফুড সাপ্লিমেন্ট’ এর ব্যবহারে সাইড ইফেক্ট সম্ভব, এবং ডাক্তারের পরামর্শ না মেনে স্বাধীনভাবে সাপ্লিমেন্ট ব্যবহার করা উচিত নয়।