প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য

প্রাথমিক গোষ্ঠী (Primary Group) :
প্রাথমিক গোষ্ঠী সমাজের মধ্যে সবচেয়ে ক্ষুদ্রতম গোষ্ঠী। তাই যে গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা বেশি বা পারস্পরিক সুসম্পর্ক পরিলক্ষিত হয়, তাকে প্রাথমিক গোষ্ঠী বলে। অর্থাৎ প্রাথমিক গোষ্ঠী হল এমন একটি গোষ্ঠী যেখানে সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিদ্যমান। প্রাথমিক গোষ্ঠীর সদস্যপদ মোটামুটি বাধ্যতামূলক। প্রতিটি ব্যক্তি নিজের অজান্তেই জন্মসূত্রে তার পরিবারের সদস্যপদ লাভ করে থাকে।

এই ধরনের গোষ্ঠীতে সদস্যরা পরস্পরের সাথে মুখোমুখি যোগাযোগ করেন এবং একে অপরের সাথে গভীরভাবে জড়িত থাকেন। মানুষ সমাজবদ্ধ জীব। নিজেদের প্রয়োজনে সমাজের মধ্যে গোষ্ঠীর জন্ম হয়েছে। প্রাথমিক গোষ্ঠীর উদাহরণ হল- পরিবার, বন্ধুবান্ধব, এবং প্রতিবেশী গোষ্ঠী।

মাধ্যমিক গোষ্ঠী (Secondary Group) :
যে গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে অন্তরঙ্গতা কম, সেই অনুযায়ী অভিজ্ঞতার আদান-প্রদান হয়, তাকে মাধ্যমিক গোষ্ঠী বলে। তাই যে গোষ্ঠীর সদস্য সংখ্যা অনেক বেশি, সদস্যদের মধ্যে পারস্পরিক সম্পর্ক বা অন্তরঙ্গতা কম হয়ে থাকে ও যে গোষ্ঠী নির্দিষ্ট উদ্দেশ্যকে কেন্দ্র করে গঠিত হয় তাকে মাধ্যমিক গোষ্ঠী বলে। অর্থাৎ মাধ্যমিক গোষ্ঠী হল এমন একটি গোষ্ঠী যেখানে সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে আনুষ্ঠানিক এবং অপরিচিত হয়।

এই ধরনের গোষ্ঠীতে সদস্যরা পরস্পরের সাথে মুখোমুখি যোগাযোগ নাও করতে পারেন এবং একে অপরের সাথে আবেগগতভাবে জড়িত হন না। গৌণ গোষ্ঠীর উদাহরণ হল স্কুল, কর্মক্ষেত্র, এবং রাজনৈতিক দল।

প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্যঃ
প্রাথমিক গোষ্ঠী এবং মাধ্যমিক গোষ্ঠী হল দুই ধরনের সামাজিক গোষ্ঠী যাদের মধ্যে পার্থক্য হল তাদের সদস্যদের মধ্যে সম্পর্কের প্রকৃতি। প্রাথমিক এবং মাধ্যমিক গোষ্ঠীর মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-

১. প্রাথমিক গোষ্ঠী হল এমন একটি গোষ্ঠী যেখানে সদস্যদের মধ্যে ঘনিষ্ঠ এবং ব্যক্তিগত সম্পর্ক বিদ্যমান। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠী হল এমন একটি গোষ্ঠী যেখানে সদস্যদের মধ্যে সম্পর্ক তুলনামূলকভাবে আনুষ্ঠানিক এবং অপরিচিত হয়।

২. প্রাথমিক গোষ্ঠী স্বতঃপ্রণোদিত বা স্বেচ্ছাপ্রণোদিতভাবে তৈরী হয়। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠী উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে তৈরী হয়।

৩. প্রাথমিক গোষ্ঠী আকারে ছোট হয়। গোষ্ঠীর আকার যত ছোট হয় , পারস্পরিক সম্পর্ক তত দৃঢ় হয়। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠী আকারে খুব বড় হয়। এমনও গোষ্ঠী আছে যারা সারা পৃথিবীজুড়ে থাকতে পারে।

৪. প্রাথমিক গোষ্ঠী গড়ে ওঠে প্রাথমিক সম্পর্কের ওপর ভিত্তি করে। এই প্রাথমিক সম্পর্ক হল মুখোমুখি , অন্তরঙ্গ , ব্যক্তিগত , একাত্মতাপূর্ণ। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠীতে মাধ্যমিক সম্পর্কের প্রাধান্য দেখা যায়। এ জাতীয় সম্পর্ক পরোক্ষ , বাহ্যিক , চুক্তিনির্ভর হয়ে থাকে।

৫. প্রাথমিক গোষ্ঠী অপেক্ষাকৃত দীর্ঘস্থায়ী। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠীগুলি সাধারণতঃ স্বল্পস্থায়ী বা অস্থায়ী। এজাতীয় গোষ্ঠীর স্থায়িত্ব মূলত উদ্দেশ্যের প্রকৃতি ও ব্যাপকতার ওপর নির্ভরশীল।

৬. প্রাথমিক গোষ্ঠীর ক্ষেত্রে দৈহিক নৈকট্যের বিষয়টি অপরিহার্য বলে বিবেচিত হয়। দৈহিক নৈকট্য না থাকলে মুখোমুখি সম্পর্ক তৈরী হয়না। অন্যদিকে , দৈহিক নৈকট্যের বিষয়টি মাধ্যমিক গোষ্ঠীতে প্রয়োজনীয় হলেও অপরিহার্য নয়। তাছাড়া , বৃহদায়তন মাধ্যমিক গোষ্ঠীতে দৈহিক নৈকট্যের বিষয়টি সবসময় সম্ভবও নয়।

৭. প্রাথমিক গোষ্ঠীর সদস্যগণ নির্দিষ্ট ভৌগোলিক ক্ষেত্রের বাসিন্দা হয়ে থাকেন। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠীর সদস্যগণ অপেক্ষাকৃত বৃহৎ ভৌগোলিক অঞ্চলের বাসিন্দা হয়ে থাকেন।

৮. প্রাথমিক গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যে যে সহযোগিতা দেখা যায় , তা মূলত প্রত্যক্ষ প্রকৃতির। যেমন , সন্তানের প্রতি মায়ের সহযোগিতা। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠীর সদস্যদের মধ্যেকার সহযোগিতা মূলত পরোক্ষ প্রকৃতির। যেমন – দূরে থাকা কোনো সদস্যের শুধুমাত্র বাৎসরিক চাঁদা প্রদান করে যে সহযোগিতা করা হয়।

৯. প্রাথমিক গোষ্ঠীর সদস্যপদ মোটামুটি বাধ্যতামূলক। যেমন- প্রতিটি ব্যক্তি নিজের অজান্তেই জন্মসূত্রে তার পরিবারের সদস্যপদ লাভ করে থাকে। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠীর সদস্যপদ ব্যক্তির ইচ্ছানির্ভর। সাধারণত , ব্যক্তির ইচ্ছার বিরুদ্ধে তাকে কোনো মাধ্যমিক গোষ্ঠীর সদস্যপদ গ্রহণ করতে বাধ্য করা যায়না। তবে , ব্যতিক্রম হিসেবে বলা যায় , রাষ্ট্র একটি মাধ্যমিক গোষ্ঠী হওয়া স্বত্তেও তার সদস্যপদ গ্রহণ ব্যক্তির পক্ষে বাধ্যতামূলক।

১0. প্রাথমিক গোষ্ঠীসমূহের প্রাধান্য সবচেয়ে বেশি সরল , গ্রামীণ , কৃষিভিত্তিক সমাজে। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠী সমূহের প্রাধান্য খুব বেশি জটিল , নগরকেন্দ্রিক , শিল্পভিত্তিক আধুনিক সমাজে।

১১. প্রাথমিক গোষ্ঠীগুলি সমাজে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। তারা ব্যক্তিদের সামাজিকীকরণ, সমর্থন, এবং আবেগগত বিকাশে সহায়তা করে। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠীগুলি সমাজে কাঠামো এবং নিয়ন্ত্রণ প্রদান করে। তারা ব্যক্তিদের কার্যাভিধানিক লক্ষ্য অর্জনে সহায়তা করে।

১২. প্রাথমিক গোষ্ঠীর উদাহরণ হল – পরিবার , অভ্যন্তরীণ গোষ্ঠী , খেলার দল – ইত্যাদি। অন্যদিকে, মাধ্যমিক গোষ্ঠীর উদাহরণ হল – রাজনৈতিক দল , রাষ্ট্র – ইত্যাদি।