চিরাচরিত ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে পার্থক্য

চিরাচরিত ব্যবস্থাপনা (Traditional Management) :
সাধারণভাবে প্রচলিত ও গতানুগতিক ধারার ব্যবস্থাপনাকে চিরাচরিত ব্যবস্থাপনা বলে। এই ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হল অভিজ্ঞতার আলোকে কার্য সম্পাদন করা। এই পদ্ধতিতে গবেষণা পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। কারণ চিরাচরিতভাবে চলে আসা পদ্ধতিতেই কাজ করা হয়। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় বিশেষায়ণ নীতি অনুসরণ করা হয় না। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় খেয়াল-খুশি অনুসারে লোক নির্বাচন করা হয় এবং কর্মীরা স্বীয় অভিজ্ঞতার কারণে দক্ষ কর্মীতে পরিণত হয়। তাঁদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না।

চিরাচরিত ব্যবস্থাপনা কোনও সংগঠনের সাধারণ কাজের সাথে সংশ্লিষ্ট হতে পারে এবং এটির প্রধান উদ্দেশ্য হল স্থিতিশীলতা এবং দৃঢ়তা বজায় রাখা। এটি সময়ের সাথে পরিবর্তন করে না এবং প্রতিষ্ঠানের উন্নতি এবং বাজারে প্রতিষ্ঠানের স্থান বজায় রাখার জন্য উপায় নির্ধারণ করে। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনা ব্যক্তিগত স্তরে বা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে করা হতে পারে, এবং এটি নির্দিষ্ট প্রতিষ্ঠান বা সংগঠনের মাধ্যমে উন্নতি এবং দৃঢ়তা নিশ্চিত করার জন্য ব্যবহার করা হতে পারে। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় পদ্ধতিগতভাবে কোনো কাজের জন্য সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টন করা হয় না।

বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা (Scientific Management) :
বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা হল চিরায়ত ধারায় প্রচলিত ত্রুটিমুক্ত ব্যবস্থাপনার পরিবর্তিত রূপ। গতানুগতিক ধারায় ব্যবস্থাপনার দর্শন, সূত্র, নিয়মাবলি, পদ্ধতি, আদর্শমান প্রভৃতির প্রয়োজনীয় পরিবর্তন, পরিবর্ধন ও পরিমার্জনের সাহায্যে সর্বপ্রথম F. W Taylor যে নতুন ধারার প্রবর্তন করেন, তাই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা।

আমরা জানি যে, বিজ্ঞান হচ্ছে জ্ঞানের সুসংবদ্ধ ও সুসংগঠিত ক্ষেত্র। তাই সাধারণ ব্যবস্থাপনায় সুসংবদ্ধ জ্ঞান বা বিজ্ঞানের ব্যবহারকেই বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা হিসেবে অভিহিত করা যায়। আবার বিস্তৃত অর্থে বলা যায় যে, প্রয়োজনীয় পর্যবেক্ষণ, গবেষণা এবং পরীক্ষা-নিরীক্ষাপূর্বক যখন ব্যবস্থাপনার প্রচলিত ধ্যান-ধারণা, দর্শন, বিশ্বাস, নিয়ম-কানুন, সূত্র, পদ্ধতি ইত্যাদির উন্নয়ন করে উৎপাদনের উৎকর্ষতা বৃদ্ধি এবং লক্ষ্য অর্জনের চেষ্টা করা হয়, তখন এরূপ ব্যবস্থাপনাকে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা বলা যায়।

F. W Taylor তাঁর “Principles of Scientific Management” পুস্তকে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার সংজ্ঞা দিয়েছেন-
Science, not rule of thumb;
Harmony, no discord;
Co-operation, not individualism;
Maximum output in lieu of limited scale;
The development of each man to his greatest efficiency.

চিরাচরিত ও বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার মধ্যে পার্থক্যঃ
একটি অনিয়মতান্ত্রিক ও অবিজ্ঞানসম্মত ব্যবস্থাপনা পদ্ধতি যার ওপর বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা এক উন্নত সংস্করণবিশেষ। ফলত, প্রাচীন ও আধুনিক ধারার এ দু’ব্যবস্থাপনার মধ্যে যথেষ্ট পার্থক্য বিদ্যমান রয়েছে। পার্থক্যগুলো নিম্নরূপ-

১। সাধারণভাবে প্রচলিত ও গতানুগতিক ধারার ব্যবস্থাপনাকে চিরাচরিত ব্যবস্থাপনা বলে। অন্যদিকে, চিরাচরিত ব্যবস্থাপনার মধ্যে বিজ্ঞানের ব্যবহার হলে তাকে বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনা বলে।

২। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হল অভিজ্ঞতার আলোকে কার্য সম্পাদন করা। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার উদ্দেশ্য হল প্রতিটি কার্যে বিজ্ঞানের ব্যবহার। এতে পূর্ব হতেই সবকিছু স্থির করা হয়।

৩। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিতে গবেষণা পরিচালনার কোনো সুযোগ নেই। কারণ চিরাচরিতভাবে চলে আসা পদ্ধতিতেই কাজ করা হয়। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় শ্রমিকের সময়, গতি ও ক্লান্তির ওপর গবেষণা করা হয় এবং তা কার্যে প্রয়োগ করা হয়।

৪। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় কোনো কার্যই প্রকৃতি বিবেচনায় বিভাগ করা হয় না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি কার্যই সঠিকভাবে ও প্রকৃতি বিবেচনা করে ভাগ করা হয়।

৫। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় বিশেষায়ণ নীতি অনুসরণ করা হয় না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় বিশেষায়ণ নীতি অনুসরণ করা হয়।

৬। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় কার্যের পরিবেশ উন্নয়নের কোনো চেষ্টা করে না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় কার্যের পরিবেশ উন্নয়নের চেষ্টা করা হয়।

৭। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় কোনো কাজের জন্যই এ ব্যবস্থাপনায় আদর্শমান স্থাপন করা হয় না বা অনুসরণ করা হয় না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি কাজের জন্যই এ ব্যবস্থাপনায় আদর্শমান অনুসরণ করা হয়। অর্থাৎ পূর্ব হতেই কাজের মান নির্ধারণ করে রাখা হয়।

৮। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় কোনো কাজের জন্য কাম্য সময় নির্ধারিত হয় না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় প্রতিটি কাজের জন্য কাম্য সময় পূর্বেই নির্ধারণ করা হয়।

৯। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনার অধীনে উৎপাদন বৃদ্ধি পায় না। মানও ঠিক থাকে না। কেননা এতে উন্নত যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল ও জনশক্তি ব্যবহার করা যায় না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় উন্নত যন্ত্রপাতি, কাঁচামাল, জনশক্তি এবং সঠিক পদ্ধতি ব্যবহার করা হয় বলে এ ক্ষেত্রে উৎপাদনের পরিমাণ ও মান সন্তোষজনক।

১০। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় খেয়াল-খুশি অনুসারে লোক নির্বাচন করা হয় এবং কর্মীরা স্বীয় অভিজ্ঞতার কারণে দক্ষ কর্মীতে পরিণত হয়। তাঁদের জন্য আলাদা প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা হয় না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনায় উপযুক্ত ও আদর্শমানের ভিত্তিতে লোক নির্বাচন ও প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। অর্থাৎ এক্ষেত্রে প্রশিক্ষণের ওপর বিশেষ জোর দেয়া হয়।

১১। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় পদ্ধতিগতভাবে কোনো কাজের জন্য সুষ্ঠুভাবে পরিকল্পনা করা হয় না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার প্রতিটি কাজের জন্য উপযুক্ত পরিকল্পনা প্রণীত হয়।

১২। চিরাচরিত ব্যবস্থাপনায় পদ্ধতিগতভাবে কোনো কাজের জন্য সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য বণ্টন করা হয় না। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যবস্থাপনার পদ্ধতিতে প্রতিষ্ঠানের সকলের মধ্যে সুষ্ঠুভাবে দায়িত্ব ও কর্তব্য সুষ্ঠুভাবে বণ্টিত হয়।