টাইপ ১ ডায়াবেটিস ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মধ্যে পার্থক্য

টাইপ ১ ডায়াবেটিস (Type 1 diabetes):

টাইপ ১ ডায়াবেটিস যা অনেক সময় বাচ্চাদের ডায়াবেটিস বা অপ্রাপ্তবয়স্কদের ডায়াবেটিস (Juvenile diabetes) নামেও পরিচিত, হচ্ছে ডায়াবেটিস বা বহুমূত্ররোগের একটি ধরন যেক্ষেত্রে শরীরে অগ্ন্যাশয় থেকে খুব-ই সামান্য বা কোনো ইনসুলিন উৎপন্ন হয় না। ইনসুলিন হচ্ছে একটি হরমোন যা রক্তের শর্করা শরীরের জন্য ব্যবহার্য করে তুলতে সহায়তা করে। চিকিৎসা করা না হলে শরীরে শর্করার পরিমাণ বেড়ে যায় যা হাইপারগ্লাইসিমিয়া নামে পরিচিত। এই রোগের প্রচলিত লক্ষণের মধ্যে রয়েছে ঘন ঘন প্রস্রাব, তৃষ্ণার্ত হওয়া, ক্ষুধা বৃদ্ধি, এবং ওজন কমে যাওয়া। অতিরিক্ত লক্ষণগুলোর মধ্যে রয়েছে অস্পষ্ট দৃষ্টি, ক্লান্তি অনুভব করা, এবং ক্ষত আরোগ্যে সময় বেশি লাগা বা জটিলতার সৃষ্টি হওয়া। উপসর্গগুলো সচারচর আক্রান্ত হওয়ার পর স্বল্প সময়ের মধ্যেই বিকাশ লাভ করে।

সকল প্রকার বহুমূত্ররোগের মধ্যে টাইপ ১ ডায়াবেটিসের পরিমাণ আনুমানিক ৫–১০%। বিশ্বজুড়ে কী পরিমাণ মানুষ টাইপ ২ ডায়াবেটিসে আক্রান্ত তা সঠিকভাবে জানা সম্ভব হয়নি তবে ধারণা করা হয় প্রতি বছর প্রায় ৮০,০০০ শিশু নতুন করে এই রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে প্রায় ১০ থেকে ৩০ লক্ষ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত। এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার হার বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে বিভিন্ন রকম। উদাহরণস্বরূপ, পূর্ব এশিয়া এবং লাতিন আমেরিকায় প্রতি বছর প্রতি ১ লক্ষে প্রায় ১ জন এই রোগে আক্রান্ত হয়, অপরদিকে স্ক্যান্ডিনেভিয়া অঞ্চলে ও কুয়েতে এই হার প্রতি বছর প্রতি লক্ষে প্রায় ৩০ জন। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সাধারণত শিশু এবং অল্পবয়স্কদের মাঝেই প্রথমে শুরু হয়।

টাইপ ২ ডায়াবেটিস (Type 2 diabetes):

টাইপ ২ ডায়াবেটিস একটি বিপাকীয় রোগ যা টাইপ ২ ডায়াবেটিস নামেও পরিচিত। রক্তে শর্করার আধিক্য, ইনসুলিনের কর্মক্ষমতা কমে যাওয়া ও শরীরে ইনসুলিনের আপেক্ষিক ঘাটতি প্রভৃতি এই রোগের বৈশিষ্ট্য। সাধারণ উপসর্গের মধ্যে রয়েছে অত্যধিক তৃষ্ণা (পলিডিপসিয়া), ঘনঘন প্রস্রাব (পলিইউরিয়া) ও ওজন হ্রাস। এছাড়া ক্ষুধাবৃদ্ধি(মিষ্টি খাবারের প্রতি অত্যধিক আসক্তি) , ক্লান্তি অনুভব ও ক্ষত নিরাময়ে বিলম্ব হওয়াও এর লক্ষণ। উপসর্গগুলো প্রায়শই ধীরেধীরে প্রকাশ পায়।

রক্তে অতিরিক্ত শর্করার উপস্থিতি অনেক দীর্ঘস্থায়ী জটিলতার সৃষ্টি করতে পারে যেমন, হৃৎপিণ্ডের রোগ, স্ট্রোক, ডায়াবেটিক রেটিনোপ্যাথি (যা অন্ধত্ব ঘটাতে পারে), কিডনি বিকলতা ও অঙ্গ-প্রত্যঙ্গে রক্ত প্রবাহের স্বল্পতা যা অঙ্গহানির কারণ হতে পারে। [১] সহসা রক্তের শর্করা বৃদ্ধি পেয়ে হাইপার অসমোলার হাইপারগ্লাইসেমিক স্টেট নামক অবস্থার সৃষ্টি করতে পারে। তবে ডায়াবেটিক কিটোঅ্যাসিডোসিস হওয়ার সম্ভাবনা কম।

টাইপ ২ ডায়াবেটিস একজন মানুষের রক্ত শর্করার মাত্রাকে উচ্চ করে তোলে। এই স্থায়ী সমস্যার লক্ষণ বা উপসর্গগুলো যত দ্রুত সম্ভব শনাক্ত করে চিকিৎসা করতে পারলে মারাত্মক জটিলতার ঝুঁকি কমে যাবে। টাইপ ২ ডায়াবেটিস খুবই প্রচলিত সমস্যা।

প্রিডায়াবেটিস হলো টাইপ ২ ডায়াবেটিসের পূর্বাবস্থা। যাদের প্রিডায়াবেটিস রয়েছে তাদের রক্ত শর্করার মাত্রাও স্বাভাবিকের চেয়ে বেশি থাকে, কিন্তু চিকিৎসকেরা তাদেরকে ডায়াবেটিস রোগী হিসেবে বিবেচনা করেন না। সিডিসির মতে, প্রিডায়াবেটিসের চিকিৎসা না করলে পাঁচ বছরের মধ্যে টাইপ ২ ডায়াবেটিস বিকশিত হতে পারে। প্রায়ক্ষেত্রে এমনটা হয়ে আসছে। টাইপ ২ ডায়াবেটিসের সূচনা হয় ধীরে ধীরে এবং প্রারম্ভিক পর্যায়ে এর উপসর্গগুলো মৃদু প্রকৃতির। ভয়াবহ পরিণতি এড়াতে টাইপ ২ ডায়াবেটিসের চিকিৎসা শুরু থেকে করা প্রয়োজন।

টাইপ ১ ডায়াবেটিস ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মধ্যে পার্থক্যঃ

ডায়াবেটিস এমন একটি রোগ যা একবার হলে মৃত্যু পর্যন্ত এই রোগকে নিয়ে বয়ে বেড়াতে হয়। টাইপ ১ ডায়াবেটিস ও টাইপ ২ ডায়াবেটিসের মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-

১। টাইপ ১ ডায়াবেটিস সাধারণত টাইপ ২ ডায়াবেটিস থেকে তুলনামূলক কম হয়ে থাকে। একে জুভেনাইল ডায়াবেটিসও বলা হয়। কারণ সাধারণত যাদের অল্প বয়সে ডায়াবেটিস ধরা পড়ে তাদের মাঝেই টাইপ ১ ডায়াবেটিস হওয়ার প্রবণতা বেশি লক্ষ করা যায়।

অন্যদিকে, টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে অগ্ন্যাশয়ে অবস্থিত ইনসুলিন উৎপাদনকারী কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয় না। তবে শরীর ইনসুলিন গ্রহণে বাধা দেয়। তাই টাইপ ২ ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে রক্তে শর্করার মাত্রা অত্যধিক হারে বেড়ে যায়।

২। টাইপ ১ ডায়াবেটিস মূলত জিনগত সমস্যার কারণে হয়ে থাকে। অপ্রাপ্তবয়স্কদের মধ্যে এই রোগটি অনেক বেশি দেখা যায়। অন্যদিকে, টাইপ ২ ডায়াবেটিস খাদ্যাভ্যাস ও শরীরের ওজনের ওপর নির্ভর করে। এই রোগের লক্ষণ শরীরে ধীরে ধীরে প্রকাশ পায়।

৩। টাইপ ১ ডায়াবেটিস শৈশবে যে কোনও সময় হতে পারে, এমনকি বৃদ্ধ বয়সেও। তবে টাইপ ১ ডায়াবেটিস রোগ সাধারণত 6 থেকে 18 বছরেরও কম অবস্থায় দেখা যায় অর্থাৎ এটি এমন একটি রোগ যা শিশুদের মধ্যে ঘটে। যদিও এই ধরণের ডায়াবেটিসে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা খুব কম, ভারতে মাত্র 1% থেকে 2% লোকের মধ্যে টাইপ ১ ডায়াবেটিস রয়েছে.

অন্যদিকে, বর্তমানে, ব্যায়ামের অভাব এবং ফাস্টফুডের উচ্চ পরিমাণের কারণে শিশুরা টাইপ ২ ডায়াবেটিসও পাচ্ছে। এটি 15 বছরের কম বয়সীদের মধ্যে দৃশ্যমান, বিশেষত 12 বা 13 বছর বয়সের মধ্যে। এটি পুরুষদের তুলনায় মহিলাদের মধ্যে বেশি দেখা যায়। এই রোগটি বেশি ওজনযুক্ত লোকদের মধ্যে বেশি দেখা যায়, সাধারণত 32 বছরের বেশি লোকের মধ্যে BMI বেশি থাকে। এটি জেনেটিক কারণেও ঘটতে পারে.

৪। এই দুই ধরনের ডায়াবেটিসের ক্ষেত্রে একই ধরনের উপসর্গ বা লক্ষণ দেখা যায়। এগুলো হলো ঘন ঘন প্রস্রাবের বেগ, গলা শুকিয়ে আসা, বার বার তৃষ্ণা পাওয়া, ক্লান্ত অনুভব করা, হঠাৎ ওজন কমে যাওয়া, দৃষ্টি ঝাপসা হয়ে আসা, শরীরে কোনো স্থানের ক্ষত সারতে বেশি সময় নেওয়া ইত্যাদি।