সংঘ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্য

সংঘ (Association):

সংঘ হলো একটি জনসমষ্টি,যারা কিছু সাধারণ উদ্দেশ্য বা উদ্দেশ্যসমূহ সাধনের জন্য একত্রিত এবং একমতে কিছু স্বীকৃত নিয়মকানুন অনুসারে পরিচালিত হয়ে একে অপরকে সহযোগিতা করে। যেমন-শিল্প ও বণিক সমিতি,ট্রেড ইউনিয়ন, প্রভৃতি।ম্যাকাইভারের মতে,”যখন কোন উদ্দেশ্য সাধনের নিমিত্তে মুষ্টিমেয় লোক সমাজবদ্ধ হয় তখন তাকে সংঘ বলা হয়।
ম্যাকাইভার ও পেজ বলেন, এক বা একাধিক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য কোনো গোষ্ঠী যখন একত্রিত হয় তখন তাকে সংঘ বলে। তাঁরা আরো বলেন, সংঘ হচ্ছে এমন একটি গোষ্ঠী যা অভিন্ন গোষ্ঠী স্বার্থ চরিতার্থ করার জন্য গঠিত হয়। এ অর্থে আমরা রাষ্ট্রকে সংঘ বলতে পারি।

জিসবার্টের মতে “সংঘ হলো একটি মুখ্য গোষ্ঠী যা কোন বিশেষ বা কতক উদ্দেশ্য সাধনের জন্য গঠিত হয়।’’
পরিবার ও রাষ্ট্রকে সংঘ হিসাবে বিবেচনা করা যায়। সংঘকে কোনো কর্ম সম্পাদনের বাহনও (agency) বলা যায়। সেক্ষেত্রে সংঘ
একটি করপোরেশন সমতুল্য। সমাজ জীবনে মানুষের চাহিদা, উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য বিচিত্র ধরনের। একক প্রচেষ্টায় মানুষের পক্ষে তার সব চাহিদা ও লক্ষ্য অর্জন করা অসম্ভব।

সম্প্রদায় (Community):

সমাজবিজ্ঞানে সমাজের পরেই যে প্রাথমিক প্রত্যয়টি বিশেষভাবে আলোচিত হয় তা হলো ‘সম্প্রদায়’। ‘সম্প্রদায়’ হচ্ছে অভিন্ন সামাজিক রীতিনীতি পালনে অভ্যস্ত জনসমষ্টি যেখানে জীবনের সামগ্রিক প্রয়োজন মিটানো সম্ভব হয়। মানুষ তার প্রয়োজনেই সমাজবদ্ধভাবে বসবাস করতে শিখেছে। সাংস্কৃতিক ও নৃতাত্বিক বৈশিষ্ট্যের কারণে বিভিন্ন এলাকায় বিভিন্ন সম্প্রদায় গড়ে উঠেছে। তাই সম্প্রদায় বলতে একটি নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাসকারী জনসমষ্টিকে বুঝায়, যারা অভিন্ন রীতিনীতি অনুসরণের মাধ্যমে জীবনযাপন করে। সম্প্রদায়ভুক্ত লোকেরা সুনির্দিষ্ট আচরণের ভিত্তিতে পরস্পর সম্পর্কযুক্ত। সম্প্রদায়হচ্ছে এমন একটি সামাজিক ব্যবস্থা যেখানে সমাজের একটি বৃহত্তর গোষ্ঠী কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় বসবাস এবং অভিন্ন মানসিকতা ধারণ করে। সম্প্রদায়ের মধ্যেই ব্যক্তির পূর্ণাঙ্গ জীবন যাপন সম্ভব। সম্প্রদায়ের সদস্যরা সুস্পষ্ট সামাজিক সংহতি অনুভব করে এবং অভিন্ন জীবনযাত্রায় অভ্যস্ত।

সম্প্রদায়ের সংজ্ঞায় সমাজবিজ্ঞানী ম্যাকাইভার ও পেজ বলেন, “Whenever the members of any group, small or large, live together in such a way that they share, not this or that particular interest but the basic conditions of common life called that group a community.”

সংঘ ও সম্প্রদায়ের মধ্যে পার্থক্যঃ

আমরা জানি যে, সংঘ হচ্ছে একটি ঐক্যবদ্ধ জনসমষ্টি যা এক বা একাধিক উদ্দেশ্য বাস্তবায়নের জন্য তৎপর এবং কয়েকটি মানবীয় উপাদান থাকে। আর সম্প্রদায় হচ্ছে একটি নির্দিষ্ট অঞ্চলে বসবাসকারী জনসমষ্টি যারা তাদের অভিন্ন জীবন ধারার অংশীদার হয়ে একত্রে বসবাস করে। নিচে সম্প্রদায় ও সংঘের মধ্যে পার্থক্য উল্লেখ করা হলো:

১। সংঘ কতকগুলি বিশেষ উদ্দেশ্য ও স্বার্থ চরিতার্থ করার লক্ষ্যে গঠিত হয়, যেমন – ক্রীড়াসংঘ। অন্যদিকে সম্প্রদায় হলো এমন একটি জনগোষ্ঠী যার সদস্যরা বিশেষ কোনো স্বার্থের অনুসারী না হয়ে অভিন্ন জীবনের প্রয়োজন মিটানোর জন্য একই এলাকায় বসবাস করে।

২। সংঘ কোনো সম্প্রদায় নয়, বরং সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত একটি সংগঠন মাত্র। যেমন, একটি গ্রাম বা শহরে অনেকগুলো সংঘ গড়ে উঠতে পারে। তাই বলা হয় সম্প্রদায় ব্যাপক আর সংঘ সীমিত সংগঠন।

৩। যেকোনো ব্যাক্তির সংঘের সদস্য হওয়া স্বেচ্ছামূলক। অন্যদিকে জন্মগতভাবে ও স্বতঃস্ফুর্তভাবে যেকোনো ব্যাক্তি সম্প্রদায়য়ের সদস্য বলে বিবেচিত।

৪। একজন ব্যক্তি সংঘের সদস্যপদ প্রত্যাহার করতে পারে। অন্যদিকে সম্প্রদায়ের অন্তর্ভুক্ত ব্যক্তিবর্গের সদস্যপদ স্থায়ী।

৫। সম্প্রদায় হচ্ছে একটি স্থায়ী সামাজিক গোষ্ঠী যার উদ্দেশ্য একাধিক বা সামগ্রিক হতে পারে। সম্প্রদায়ভুক্ত লোক সম্প্রদায়ের মধ্যে থেকে নিজ নিজ উদ্দেশ্য সাধন করতে পারে। অন্যদিকে সংঘ ক্ষণস্থায়ী, তার উদ্দেশ্য ও স্বার্থের বাস্তবায়ন না হলে তা নাও টিকতে পারে।

৬। সংঘের সদস্যরা এর নীতি, আদর্শ ও নিয়ম-কানুন মেনে চলতে বাধ্য। অন্যদিকে সম্প্রদায়ভুক্ত সদস্যরা তাদের অভিন্ন স্বার্থ ও উদ্দেশ্যকে মনে রেখে সামাজিক প্রথা, ঐতিহ্য ও রীতিনীতির মাধ্যমে পরিচালিত ও নিয়ন্ত্রিত হয়ে থাকে।

৭। সংঘের আইনগত অবস্থান রয়েছে। প্রয়োজনে সংঘের সদস্য বা সদস্যরা সংঘের কার্যক্রম বা সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে আইনের আশ্রয় নিতে পারে। অন্যদিকে সম্প্রদায়ের ক্ষেত্রে তা প্রযোজ্য নয়।