বাঙালি ও বাংলাদেশী -এর মধ্যে পার্থক্য

বাঙালি (Bengali):

বাঙালি শব্দটি বর্ণনা করে এমন একজন যার ভাষাগত, বংশগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় মূলত বাংলার মাটি থেকে। এই ইন্দো-আর্য বাঙালি জাতি বাংলার অন্য অনার্য জাতিগুলো থেকে আলাদা। বাঙালি এবং বাংলা, উভয় শব্দের উৎপত্তি হচ্ছে বাঙ্গালা শব্দে থেকে, যা ছিল ফার্সী ভাষায় এই অঞ্চলের নাম। মুসলমানদের প্রসারের আগে, বাঙ্গালা বা বাংলা নামে কোন অঞ্চল ছিল না কারণ এই অঞ্চলটি অসংখ্য ভূরাজনৈতিক উপরাজ্যে বিভক্ত ছিল। যেমন দক্ষিণাঞ্চলের বঙ্গ , পশ্চিমাঞ্চলের রাঢ়, উত্তরাঞ্চলের পুণ্ড্রবর্ধন ও বরেন্দ্র, এবং পূর্বাঞ্চলের সমতট ও হরিকেল। প্রাচীন কালে, এই অঞ্চলের মানুষ এসব বিভাগগুলির নাম দিয়ে তাদের সাংস্কৃতিক পরিচয় দিতেন। যেমন মহাভারতের মত বৈদিক গ্রন্থগুলিতে পুণ্ড্র নামের একটি জাতির উল্লেখ আছে। ইব্রাহিমীয় ও ভারতীয় ধর্মগুলির ইতিহাসবিদরা মনে করে যে প্রাচীন বঙ্গ রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা হচ্ছে বঙ্গ নামক এক ব্যাক্তি যিনি এই অঞ্চলে বসবাস শুরু করেছিলেন। ইব্রাহিমীয় বংশবিজ্ঞানীরা ধারণা করতেন যে বঙ্গ ছিল নূহের ছেলে হামের নাতি।

বাঙালি জাতি বা বাঙালী জাতি দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ একটি ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর নাম। স্থানীয় জনসংখ্যা স্বাধীন বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, ত্রিপুরা, বরাক উপত্যকা এবং নিম্ন আসাম ও মণিপুরের কিছু অংশের মধ্যে বিভক্ত। তাদের অধিকাংশই বাংলায় কথা বলে, যা ইন্দো-ইরানি ভাষাসমূহের বিশেষ একটি ভাষা।

চীনা এবং আরবদের বাদে বাঙালিরা পৃথিবীর ৩য় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। তারা ইন্দো-ইউরোপীয়দের মাঝে বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। তাদের আদি অঞ্চল ছাড়াও আন্দামান ও নিকোবর জিঞ্জিরায় বাঙালি সংখ্যাগরিষ্ঠ রয়েছে। এছাড়াও অরুণাচল প্রদেশ, দিল্লি, ওড়িশা, ছত্তিশগড়, ঝাড়খণ্ড, মেঘালয়, মিজোরাম, নাগাল্যান্ড, উত্তরাখণ্ড এবং নেপালের প্রদেশ নং ১-এ উল্লেখযোগ্য জনসংখ্যা রয়েছে।

বাংলাদেশী (Bangladeshi):

বাংলাদেশ দক্ষিণ এশিয়ার একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ। দক্ষিণ এশীয়ায় ব্রিটিশ শাসনের শেষাংশে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে ভারতীয় উপমহাদেশের যে বিভাজন করে, তার আগে বাংলাদেশ এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ একই ভূখণ্ড ছিল, এবং এদের উভয়ের মুখের ভাষা ছিল বাংলা। তাই এই জাতিকে বাঙালি হিসেবেই চিনতো বিশ্ব। কিন্তু পরবর্তিতে দ্বিজাতিতত্ত্বের ভিত্তিতে বিভাজনের মাধ্যমে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ থেকে পৃথক করে বাংলাদেশ ভূখণ্ডটিকে দেওয়া হয় পাকিস্তানের অধীন করে। সেখান থেকে ১৯৭১ খ্রিষ্টাব্দে রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের মাধ্যমে স্বাধীন হয় বাংলাদেশ।

বাংলাদেশী বলতে সাধারণভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসকারী বা অধিবাসী জনগণকে বোঝানো হয়ে থাকে। এর মধ্যে বাঙালি এবং কিছু উপজাতিও অন্তর্ভুক্ত। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬ ধারার ২ উপধারায় বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের জনগণ জাতি হিসাবে বাঙালী এবং নাগরিকগণ বাংলাদেশী বলিয়া পরিচিত হইবেন।

বাংলাদেশী বলতে মূলত বাংলাদেশের আদিবাসী বাঙালি এবং উপজাতি নাগরিককে বোঝানো হয়; তারা দেশেই অবস্থান করুন বা অন্য কোনো দেশে বসবাস করুন। একজন ব্যক্তির বাংলাদেশী নাগরিকত্ব নির্ধারিত হবে আইনের শর্তানুযায়ী। বাংলাদেশের সংবিধানের ৬ ধারার ১ উপধারায় বলা হয়েছে যে “বাংলাদেশের নাগরিকত্ব আইনের দ্বারা নির্ধারিত ও নিয়ন্ত্রিত হইবে। জন্মসূত্রে বংশসূত্রে প্রবাসীসূত্রে বিবাহিত সূত্রে ও দেশীয়সূত্রে এবং অন্যান্য সূত্রে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব লাভ করেন।

বাঙালি ও বাংলাদেশী -এর মধ্যে পার্থক্যঃ

বাঙালি ও বাংলাদেশীর মধ্যে মধ্যে অনেকটা মিল থাকলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে অমিল রয়েছে। তাই নিচে বাঙালি ও বাংলাদেশী -এর মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে-

১। বংশগত ভাবে বাঙ্গালী হলে বা বাংলা ভাষায় যারা কথা বলে তারা পৃথিবীর যে কোনো দেশে বসবাস করলেও তারা বাঙ্গালী। অন্যদিকে, বাংলাদেশের নাগরিক হলেই পরে বাংলাদেশী হয়।

২। বাঙ্গালী হচ্ছে জাতি । অন্যদিকে, বাংলাদেশী হচ্ছে জাতীয়তা।

৩। বাংলা ভাষা-ভাষীকে বাঙ্গালী বলে। অন্যদিকে, বাংলাদেশী বলতে মূলত বাংলাদেশের আদিবাসী বাঙালি এবং উপজাতি নাগরিককে বোঝানো হয়।

৪। একজন বাঙালি যার ভাষাগত, বংশগত ও সাংস্কৃতিক পরিচয় মূলত বাংলার মাটি থেকে। অন্যদিকে, বাংলাদেশী সাধারণভাবে দক্ষিণ এশিয়ার বাংলাদেশ ভূখণ্ডে বসবাসকারী বা অধিবাসী জনগণ।

৫। বাঙালি জাতি বা বাঙালী জাতি দক্ষিণ এশিয়ার বিশেষ একটি ইন্দো-আর্য জাতিগোষ্ঠীর নাম। অন্যদিকে, দক্ষিণ এশিয়ার একটি সার্বভৌম রাষ্ট্র। বাংলাদেশের সাংবিধানিক নাম গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ।