পুঁজিবাদী ও ইসলামী অর্থব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্য

পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থা (Capitalist economics):
পুঁজিবাদ হল একটি অর্থনৈতিক ব্যবস্থা যা ব্যক্তিগত মালিকানা, উৎপাদনের উপায়ের নিয়ন্ত্রণ এবং লাভের জন্য তাদের পরিচালনার উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত। অর্থাৎ যে অর্থব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তি বা ফার্ম উৎপাদন, বন্টন ও ভোগের ক্ষেত্রে পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করে এবং বাজার ব্যবস্থা সরকারি হস্তক্ষেপমুক্ত থাকে, তাকে ধনতান্ত্রিক বা পুজিবাদী অর্থব্যবস্থা বলে। এ ধরনের বাজার ব্যবস্থায় প্রতিটি ব্যক্তি বা ফার্ম কোথায় বিনিয়োগ করবে, কি উৎপাদন বা বিক্রয় করবে, কি দামে দ্রব্য বা সেবা বিনিময় করবে- এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেয়ার ক্ষেত্রে স্বাধীন থাকে। অর্থাৎ ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থায় দ্রব্য বা সেবার দাম বাজারে চাহিদা ও যোগান এর মাধ্যমে নির্ধারিত হয়।

এখানে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে সরকারের সরাসরি নিয়ন্ত্রণ থাকে না। বর্তমানে পুরোপুরি ধনতান্ত্রিক বাজার অর্থব্যবস্থায় না থাকলেও যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, অষ্ট্রেলিয়া প্রভৃতি দেশে ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থার প্রায় কাছাকাছি অর্থব্যবস্থা বিদ্যমান।

ইসলামী অর্থব্যবস্থা (Islamic economics):
ইসলামী অর্থনীতি (الاقتصاد الإسلامي‎‎) হলো কুরআন ও সুন্নাহ মোতাবেক অর্থনৈতিক লেনদেন ব্যবস্থা। ইসলামী কৃষ্টি ও তামাদ্দুন সমৃদ্ধ যে অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে তাই ইসলামী অর্থনীতি। প্রখ্যাত সমাজ বিজ্ঞানী ইবনে খালদুন বলেন- ইসলামী অর্থনীতি হলো জনসাধারণের সাথে সম্পর্কিত বিজ্ঞান। মহান সৃষ্টিকর্তা আল্লাহর নীতি-পদ্ধতি অনুসরণে সৃষ্টির লালন-পালনের যাবতীয় জাগতিক সম্পদের সামগ্রিক কল্যাণধর্মী ব্যবস্থাপনাই ইসলামী অর্থনীতি।

প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ ডঃ এম নেজাতুল্লাহ সিদ্দিকী বলেন- “ইসলামী অর্থনীতি সমকালীন অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় মুসলিম চিন্তাবিদদের জবাব”। ডঃ এম এ মান্নান বলেন- “ইসলামী অর্থনীতি হলো একটি সামাজিক বিজ্ঞান যা কুরআন ও সুন্নাহর আলোকে মানুষের অর্থনৈতিক সমস্যাবলি নিয়ে আলোচনা করে”।

পুঁজিবাদী ও ইসলামী অর্থব্যবস্থার মধ্যে পার্থক্যঃ

ইসলামী অর্থব্যবস্থার মূলনীতিগুলোর সাথে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার মূলনীতির আংশিক মিল দেখা যায়। এ কারণেই সমাজতন্ত্রের ধারকরা বর্তমান ইসলামী অর্থব্যবস্থাকে পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থার আপডেট ভার্সন বলে থাকেন এবং উভয় অর্থব্যবস্থার পরিণাম একই হবে মর্মে বলে থাকেন। অথচ উভয় অর্থব্যস্থার অর্থনৈতিক সাফল্য, যুগোপযোগিতা ও পরিণামের মধ্যে বিশাল পার্থক্য আছে। তা নিম্নরূপ-

১. পুঁজিবাদ হলো ধনতান্ত্রিক অর্থব্যবস্থা। অন্যদিকে ইসলামি অর্থব্যবস্থা হলো শরিয়তের ওপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত অর্থব্যবস্থা।

২. পুঁজিবাদী অর্থব্যবস্থায় ব্যক্তি-মালিকানা এবং ব্যক্তি-স্বার্থের চেতনাকে অর্থনৈতিক সিদ্ধান্ত গ্রহণে লাগামহীন শক্তি এবং সীমাহীন স্বাধীনতা দেওয়া হয়েছে এবং তাদের এ স্বাধীনতাকে কোনো ধরনের ধর্মীয় শিক্ষার মাধ্যমে নিয়ন্ত্রণ করা হয়নি। যদি কোথাও কিছু নিয়ন্ত্রণ থেকেও থাকে তাও স্বয়ং মানুষ কর্তৃক আরোপিত। এরূপ ব্যবস্থা এমন বহু কার্যকলাপের সুযোগ সৃষ্টি করে দিয়েছে, যা সমাজে (অর্থনৈতিক) বৈষম্য সৃষ্টির কারণ হয়ে যায়। সুদ, জুয়া এবং লটারি সম্পদকে গুটিকতেক লোকের হাতে পুঞ্জীভূত করে রাখার সুযোগ করে দেয়। অর্থোপার্জনের লক্ষ্যে অশালীন ও ক্ষতিকর দ্রব্য এবং সেবা (Service) আবিষ্কারের মাধ্যমে অসুস্থ মানুষের আবেগকে ব্যবহার করা হয়।

ধন-সম্পদ উপার্জনের লাগামহীন আগ্রহ ও স্পৃহা ইজারাদারি সৃষ্টি করে। ফলে বাজারের ক্ষমতা (চাহিদা ও জোগান) হয়তো স্থবির ও শ্লথ হয়ে যায়। অথবা কমপক্ষে তার স্বাভাবিক কার্যক্রমে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি হয়। সুতরাং পুঁজিবাদী ব্যবস্থা যা বাজার-ক্ষমতার ভিত্তিতে প্রতিষ্ঠিত বলে দাবিদার, কার্যত চাহিদা ও জোগানের স্বাভাবিক নিয়মে তা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করে।

অন্যদিকে, এ অবস্থার প্রেক্ষিতে সৃষ্ট অপকর্ম ও অশ্লীলতাকে প্রতিরোধ করার জন্য এ ছাড়া আর কোনো পথে নেই যে আল্লাহপ্রদত্ত ক্ষমতা মেনে নিয়ে তাঁর বিধি-বিধানের আনুগত্য স্বীকার করতে হবে এবং সে বিধানাবলিকে এমন যথার্থ মনুষ্য-শক্তির ঊর্ধ্বের হিদায়াত হিসেবে গ্রহণ করতে হবে, যার ওপর সর্বাবস্থায় যেকোনো মূল্যে আমল করা অত্যাবশ্যক বলে গণ্য হবে। মূলত এটাই ইসলামী জীবনব্যবস্থার সারকথা। ব্যক্তি মালিকানা ও ব্যক্তি স্বার্থের চেতনা এবং বাজারের ক্ষমতা মেনে নিয়ে ইসলাম অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ডের ওপর আল্লাহপ্রদত্ত বিশেষ কিছু বিধি-নিষেধ আরোপ করে দিয়েছেন। এসব বিধি-নিষেধ যেহেতু আল্লাহর পক্ষ থেকে আরোপিত।

৩. পুঁজিবাদ অর্থনীতিতে মালিকশ্রেণী তার ইচ্ছামতো সুদ নিজের আওতায় রাখতে পারবে। অন্যদিকে, ইসলামি অর্থনৈতিক ব্যবস্থাতে এই সুবিধা নেই। কারণ ইসলামি অর্থনীতিতে সুদ জিনিসটাই হারাম।

৪. পুঁজিবাদ অর্থনীতিতে মালিক শ্রমিকের মজুরি প্রাপ্য থেকে কম দিতে পারেন। অর্থাৎ মুনাফার যেটুকু অংশ শ্রমিকের হিসেব-নিকাশে প্রাপ্য সেটার চেয়ে কম মজুরি দেওয়ার অধিকার রয়েছে মালিকের। অন্যদিকে ইসলামি অর্থনীতিতে এরকম কাজ নীতিহীন। শ্রমিককে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব তার মজুরি প্রদান করতে হবে।

৫. পুঁজিবাদ অর্থনীতিতে মালিক শ্রেণী সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখতে পারেন এবং তা হতে প্রাপ্ত লভ্যাংশ অন্যক্ষেত্রে বিনিয়োগ করতে পারবেন। অন্যদিকে, ইসলামিক অর্থনীতির অন্যতম বৈশিষ্ট্য যাকাত যেটা সম্পদ পুঞ্জিভূত করে রাখার বিরুদ্ধে যায়। পুরো একবছরে নিসাব পরিমাণ সম্পদের অধিকারী প্রত্যেক নারী-পুরুষকে বছরান্তে ২.৫০% যাকাত নির্দিষ্ট খাতে ব্যয় করতে হয়।

৬. পুঁজিবাদী অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় সুদ গ্রহণের ক্ষেত্রে বৈধতা রয়েছে। অন্যদিকে, ইসলামি অর্থব্যবস্থায় সুদ নয় মুনাফা গ্রহণে বাধ্যবাধকতা রয়েছে।