মোহরানা ও কাবিননামার মধ্যে পার্থক্য

মোহরানা (Mohrana):

মহর বা মোহর (مهر‎‎;‎‎) হল বিবাহের সময় কনের দাবিকৃত অর্থ বা সম্পদ, যা বর বা বরের পিতার পক্ষ থেকে কনেকে প্রদান করতে হয়। এটি প্রদান করা বাধ্যতামুলক। মহরের মাধ্যমেই পুর্ণাঙ্গ বিয়েকে বৈধ করা হয়। প্রাচীন আরবে যৌতুক দেয়ার প্রথা চালু ছিল, নবুয়াত প্রাপ্তির পর মুহাম্মদ (স.) আল্লাহ তায়ালার নির্দেশে যৌতুক প্রথাকে নিষিদ্ধ করে আবশ্যক দেনমহর প্রথা চালু করেন।

ইসলামে মহরের কোন সীমারেখা নেই। যা বরের আর্থিক অবস্থার উপর নির্ভর করে নির্ধারণ করা হয়। তোমরা নারীদেরকে দাও তাদের মোহর খুশিমনে। এরপর তারা যদি স্বেচ্ছায় স্বাগ্রহে ছেড়ে দেয় কিছু অংশ তোমাদের জন্য তাহলে তা স্বাচ্ছন্দে ভোগ কর। রাসূল (সা.) বলেছেন, বিবাহের সবচেয়ে বড় শর্ত হল মোহর।

কাবিননামা (Kabinnama):

কাবিননামা বলতে বিবাহ সম্পাদনের লিখিত চুক্তি বোঝায়। একে নিকাহনামা বলেও উল্লেখ করা হয়। বিবাহ সম্পাদনের জন্য বা বিবাহ বৈধ হওয়ার জন্য ‘কাবিননামা’ অপরিহার্য নয়। কাবিননামা একটি আইনি বাধ্যবাধকতা। বাংলাদেশের আইন অনুযায়ী সরকার কর্তৃক মনোনীত কাজী সরকার নির্ধারিত ছকে কাবিননামা সম্পাদন করে থাকেন। স্ত্রীর প্রাপ্য দেনমোহর আদায়, স্ত্রীর ভরণপোষণ, উত্তরাধিকার নির্ণয়, সন্তানের পিতৃত্ব ইত্যাদি ক্ষেত্রে যথাযথভাবে নিবন্ধিত কাবিননামা একটি আইনি দলিল।

মুসলিম বিবাহ ও তালাক (রেজিস্ট্রেশন) আইন ১৯৭৪ মোতাবেক অনুযায়ী প্রতিটি বিবাহ নিবন্ধন করতে হবে। সরকার নির্ধারিত কাজী বিবাহের নিবন্ধন করবেন। বিবাহ নিবন্ধনের ক্ষেত্রে বরপক্ষ নিবন্ধন ফি প্রদান করবে। বিয়ে নিবন্ধনের পর কাজী তথা নিকাহ রেজিষ্টার স্বামী ও স্ত্রীকে কাবিননামার সত্যায়িত কপি প্রদানে বাধ্য।

মোহরানা ও কাবিননামার মধ্যে পার্থক্যঃ

কাবিননামা বলতে বিবাহ সম্পাদনের লিখিত চুক্তি বোঝায়। একে নিকাহনামা বলেও উল্লেখ করা হয়। মোহরানা ও কাবিননামার মধ্যে পার্থক্য নিম্নরূপ-

নর ও নারীর দাম্পত্য জীবনকে সঠিকভাবে পরিচালনা করিবার জন্য বিবাহের সময় পাত্র ও পাত্রী পক্ষের পরস্পরের সম্মতিতে কতিপয় শর্ত চুক্তি নামার ভিত্তিতে অর্থাৎ পাত্র-পাত্রীর পূর্ণ নাম ঠিকানা, বিবাহের তারিখ, মোহরের পরিমাণ, উকিল ও সাক্ষীগণের নামও ঠিকানা এবং আরও কতিপয় শর্তসমূহ কাজীর অফিসে সরকারী ফরমে লিপিবদ্ধ করাকে কাবিন নামা বলা হইয়া থাকে।

এই কাবিন নামা স্ত্রী জাতির মান-সম্মান, ইজ্জৎও অধিকার প্রতিষ্ঠিত করিবার জন্য রক্ষা কবজ বা দলিল হিসাবে পরিগণিত। এই কাবিন নামায় পাত্র-পাত্রী পক্ষের নামও ঠিকানা লিপিবদ্ধ করা হয়। ইহাতে পাত্র-পাত্রীর নাম ঠিকানা, বয়স, প্রথম বিবাহ না দ্বিতীয় বিবাহ, দ্বিতীয় বিবাহ হইলে উহার কারণসমূহ, পাত্র-পাত্রীর দস্তখত, উকিল ও সাক্ষীগণের দস্তখত এবং যে বিবাহ পড়াইয়াছেন তাহার দস্তখত দিতে হয়। ইহাতে আরও উল্লেখ থাকিবে দেনমোহরের পরিমাণ, নগদ ও বাকীর সংখ্যা, খোরপোষের পরিমাণ, স্ত্রীকে তালাক লইবার ক্ষমতা এবং অন্যান্য শর্তাদিসমূহ।

অনেক পুরুষগণ উচ্ছৃঙ্খল ও স্বেচ্ছাচারী হইয়া স্ত্রীদের উপর নানা প্রকার উৎপীড়ন ও অত্যাচার করিয়া থাকে, বিভিন্নভাবে অকথ্য নির্যাতন ও দুর্বব্যবহার করিয়া থাকে। তাই পুরুষগণ যাহাতে দাম্পত্য জীবনে স্ত্রীগণের সহিত যাহা ইচ্ছা ব্যবহার করিতে না পারে সেই জন্য কাবিননামা সম্পাদন করা অতি উত্তম প্রথা বা নিয়ম। কাবিনের মধ্যে লিখা থাকিবে যে, স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া-বিবাদের কারণে মনোমালিন্য বা অবর্গতার সৃষ্টি হইলে উহা দূর করিবার জন্য ইচ্ছা করিলে স্ত্রী তাহার পিত্রালয় অবস্থান করিবে। স্বামী সেখানে স্ত্রীর জন্য বাজার দর হিসাবে তাহার খোরপোষের ব্যবস্থা করিবে।

স্বামী নিরুদ্দেশ হইলে বা স্ত্রীর খোজ খবর না লইলে ছয়মাস বা এক বৎসর অপেক্ষা করিয়া স্ত্রী তালাক নামা সম্পাদন করিবার ক্ষমতা লাভ করিবে। ইত্যাদি শর্তসমূহ কাবিন নামায় উল্লেখ থাকিবে। আবার স্ত্রী অন্য লোকের কুপরামর্শে মিথ্যার আশ্রয় গ্রহণ করিয়া স্বামীকে তালাক দিয়া অন্য পুরুষকে স্বামী হিসাবে গ্রহণ করা অন্যায় বা হারাম। সুতরাং প্রতিটি বিবাহের পূর্বে কাবিন নামা সম্পাদন করা প্রত্যেক কন্যার পিতার বা ওলির জন্য অবশ্য কর্তব্য কার্য। ইহা একটি শরীয়ত সম্মত সরকারী আইন বটে।

বিবাহের পূর্বে বিবাহ বন্ধনের বিনিময়ে স্বামী কর্তৃক স্ত্রীকে যে অর্থ প্রদান করা হইয়া থাকে, তাহাকে মোহর বা দেনমোহর বলা হইয়া থাকে। বিবাহ কার্য সম্পন্ন করিবার পূর্বেই দেন মোহর ঠিক করিতে হয় এবং বিবাহ পড়াইবার পরে উহা প্রদান করা নিয়ম। তবে নির্দিষ্ট পরিমাণ অর্থ ধার্য করিয়া উহার অর্ধেক বাকী রাখিয়া পরে শোধ করিবার অঙ্গিকার করাইয়া বিবাহ পড়ার দুরূস্ত আছে। আর মোহরানার অর্থ কিছু পরিমাণ আদায় না করিলে বিবাহ দুরুস্ত হইবে না। মোহরানার অর্থের পরিবর্তে ঐ পরিমাণ স্বর্ণের জেওর স্ত্রীকে দেওয়া জায়েজ আছে।

মোহর ধার্য করিবার সময় পাত্রের সামর্থের প্রতি লক্ষ রাখিয়া দেনমোহর ধার্য করিতে হয়। কেননা স্ত্রীর দেনমোহর অর্থ আদায় করা স্বামীর উপর ফরজ। যদি স্বামী স্ত্রীর দেন মোহরের অর্থ পরিশোধ না করিয়া মৃত্যু মুখে পতিত হয়, তবে স্বামী ঋণী থাকিবে এবং রোজ হাশরে বিচারের সময় ইহার জন্য দোযখে যাইতে হইবে। তবে যদি স্ত্রী মাফ করিয়া দেয় তবে নাজাত পাইতে পারে। আল্লাহ তায়ালা কোরআন শরীফে এরশাদ করিয়াছেন- “হে নবী! আমি আপনার স্ত্রীগণকে আপনার জন্য হালাল করিয়াছি, যাহাদিগকে আপনি মোহরানা দিয়াছেন।”

অন্য এক আয়াতে আল্লাহ তায়ালা বলিয়াছেন-” তাহাদিগকে বিবাহ করিতে তোমাদের দোষ নাই যদি তাহাদের মোহরানা দিয়া থাক। তোমাদের স্ত্রীগণকে তাহাদের মোহরানা সদকা স্বরূপ দাও। কিন্তু যদি তাহারা ইহার কিছু অংশ মাফ করিয়া দেয়, তাহা সন্তুষ্ট চিত্তে উপভোগ কর। হযরত নবী করীম (সাঃ) এরশাদ করিয়াছেন-”নিশ্চয়ই সেই বিবাহে বেশী বরকত হয়, যে বিবাহে মহর খুব কম হয়।” হযরত রাসূলে পাক (সাঃ) আরও ফরমাইয়াছেন-”ঐ মেয়ে সব চাইতে ভাল, যে দেখিতে সুন্দরী ও যাহার মোহর খুব কম।”