দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্য

দর্শন (Philosophy):

ইংরেজি Philosophy শব্দের প্রতিশব্দ ‘দর্শন’। দর্শন শব্দটি মূলতঃসস্কৃতি শব্দ যার পারিভাষিক অর্থ হচ্ছে বস্তুর প্রকৃত সত্তা বা তত্ত¡ দর্শন। সস্কৃতি ‘দৃশ’ধাতু থেকে দর্শন শব্দটির উৎপত্তি, যার অর্থ হচ্ছে দেখা। এখানে দেখা শব্দটি তত্ত¡ দর্শন বা জীবন-জগতের স্বরূপ উপলব্ধি কে বুঝায়। অন্যদিকে ইংরেজি Philosophy শব্দটির উৎপত্তি গ্রিক শব্দ Philos এবং Sophia থেকে। Philos অর্থ অনুরাগ এবং Sophia অর্থ জ্ঞান বা প্রজ্ঞা। তাই Philosophy শব্দটির বুৎপত্তিগত অর্থ জ্ঞন বা প্রজ্ঞার প্রতি অনুরাগ। আর সে দিক থেকে বিচার করলে জ্ঞানানুরাগী বা প্রজ্ঞানুরাগী ব্যক্তি মাত্রই এক একজন দার্শনিক। সংক্ষেপে বলা যায় প্রজ্ঞাপ্রীতিই দর্শন, আর প্রজ্ঞা প্রেমিকই দার্শনিক।

গ্রিক দার্শনিক পিথাগোরাস (খ্রি. পূর্ব আনুমানিক ৫৭২-৪৯৯) সে কারণেই একজন দার্শনিক হিসেবে স্বীকৃতি ও সুখ্যাতি লাভ করেন। যদিও বাংলায় ‘দর্শন’ শব্দটি ইংরেজি Philosophy শব্দটি থেকে ভিন্ন, তথাপি আলোচনার বিষয়বস্তু ও লক্ষ্য উদ্দেশ্যের দিক দিয়ে উভয়ের মধ্যে যথেষ্ট সাদৃ্শ্য রয়েছে। উভয়ের উদ্দেশ্য জ্ঞানানুরাগ বা প্রজ্ঞানুরাগ। আলোচ্য বিষয়ের এ সাদৃশ্যের কথা বিবেচনা করেই বঙ্গভারতীয় পন্ডিত গণ Philosophy -র বাংলা প্রতিশব্দরূপে দর্শন শব্দটি ব্যবহার করে আসছেন।

বিজ্ঞান (Science):

বিজ্ঞান শব্দটি ইংরেজি ‘Science’ শব্দের বাংলা অনুবাদ। Science শব্দটি আবার এসেছে ল্যাটিন শব্দ ‘Scientia’ থেকে, যার অর্থ জ্ঞান। বাংলায় বিজ্ঞান শব্দটিকে বিশ্লেষণ করলে পাওয়া যায় বি+জ্ঞান, যার অর্থ দাঁড়ায় বিশেষ জ্ঞান। অর্থাৎ কোন বিষয়ে বিশেষ জ্ঞান কে বলা হয় বিজ্ঞান। এবার মনে প্রশ্ন জাগতে পারে যে এই “বিশেষ জ্ঞান” আবার কি! আসলে এই “বিশেষ জ্ঞান” ই হল কোন ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞান। ভৌত বিশ্বের যা কিছু পর্যবেক্ষণযোগ্য, পরীক্ষণযোগ্য ও যাচাইযোগ্য, তার সুশৃঙ্খল, নিয়মতান্ত্রিক গবেষণা ও সেই গবেষণালব্ধ জ্ঞানভাণ্ডারের নাম বিজ্ঞান।

বর্তমান বিশ্ব এবং এর প্রগতি নিয়ন্ত্রিত হয় বিজ্ঞানের মাধ্যমে। তাই এর গুরুত্ব অপরিসীম। ব্যাপক অর্থে যেকোনো জ্ঞানের পদ্ধতিগত বিশ্লেষণকে বিজ্ঞান বলা হলেও এখানে বিশেষায়িত ক্ষেত্রে শব্দটি ব্যবহার করা হবে। বিজ্ঞান চর্চার সূত্র সুদূর অতীত ৩০০০ থেকে ১২০০ বিসিই সময়কালে প্রাচীন মিশর এবং মেসোপটেমিয়ায় পাওয়া যায়।

দর্শন ও বিজ্ঞানের মধ্যে পার্থক্যঃ

দর্শন ও বিজ্ঞানের মাঝে লক্ষ্য, উদ্দেশ্য ও আলোচ্য বিষয়ের দিক থেকে মিল থাকলেও উভয়ের মধ্যে আলোচনার পদ্ধতি ও পরিণতির দিক থেকে পার্থক্য রয়েছে। তা নিম্নরূপ-

১. মানব অভিজ্ঞতার সকল দিক নিয়ে দর্শন আলোচনা করে অর্থাৎ দর্শনের দৃষ্টিভঙ্গি সার্বিক বা অখন্ড। অন্যদিকে, বিজ্ঞানের দৃষ্টিভঙ্গি খন্ডিত বা বিশেষ। কারণ প্রতিটি বিজ্ঞান একটি বিশেষ বিভাগ নিয়ে আলোচনা করে। যেমন- পদার্থ বিজ্ঞান শুধু পদার্থের প্রকৃতি নিয়েই আলোচনা করে। জীব বিজ্ঞান কেবল জীব নিয়েই আলোচনা করে।

২. দর্শন যুক্তির কষ্টি পাথরে সব কিছুকে যাচাই করে তার ব্যাখ্য বিশ্লেষণ করে। অন্যদিকে, বিজ্ঞান বিনা বিচারে কতক গুলো স্বত:সিদ্ধ নীতিমালাকে স্বীকার করে নিয়ে বিষয়বস্তুর ব্যাখ্য প্রদান করে।

৩. দর্শনের পদ্ধতি হলো বিচার বিশ্লেষণ ও যৌক্তিক ব্যাখ্য দান। অন্যদিকে বিজ্ঞানের পদ্ধতি হলো অভিজ্ঞতা ভিত্তিক। যেমন- পর্যবেক্ষণ, পরীক্ষণ ও আরোহ পদ্ধতি।

৪. দর্শন বস্তুর প্রাতিভাসিকও অভ্যন্তরীণ উভয় সত্তা নিয়েই আলোচনা করে। বস্তুর প্রাতিভাসিক রূপের অন্তরালে কোন পরমসত্তা আছে কিনা সেটা নিয়েও দর্শন আলোচনা ও অনুসন্ধান করে। অন্যদিকে, বিজ্ঞান শুধু বস্তুর স্বরূপ নির্ধারণ করে এর অন্তরালে পরম সত্তার সন্ধান সে করে না।

৫. দর্শনের কাজ মূল্যের মূল্যধারণ করা। বস্তুর পরিমাণগত ও গুণগত উভয় দিকই দর্শন আলোচনা করে। কিন্তু বিজ্ঞান শুধু পরিমাণগত দিক নিয়ে আলোচনাতেই থাকে। তাই দর্শনের পরিধি বিজ্ঞানের চেয়ে অনেক বেশী ব্যাপক।

৬. দর্শনের পদ্ধতি ব্যাপক হওয়াতে একই বিষয়ে দার্শনিকদের মধ্যে যথেষ্ট বাক্যচিরন্ত ও মতবিরোধ দেখা যায় এবং ফলে দর্শন প্রদত্ত সিদ্ধান্ত সর্বজনীন ও সুনিশ্চিত হয় না। অন্যদিকে, বিজ্ঞান বিশেষ একটি বিভাগ নিয় কাজ করে বলে তার সিদ্ধান্ত অনেক বেশি সুনিশ্চিত ও সর্বজনীন হয়।

৭ .বিজ্ঞান বস্তুর যে ব্যাখ্য দেয় তা সবসময় পরীক্ষা নিরীক্ষা ও যাচাই করে প্রমাণ করা যায়। অন্যদিকে, দার্শনিক আলোচনার বিষয়কে সেভাবে প্রমাণ করা যায় না।

৮. দর্শন জীবনকে এক সার্বিক দৃষ্টিভঙ্গীতে ব্যাখ্য ও মূল্যায়ন করে থাকে। জীবনের মৌলিক প্রশ্ন গুলোর কোন দিকই তাতে বাদ পড়ে না। অন্যদিকে, বিজ্ঞান সেখানে জীবনকে ব্যাখ্য দেয় গাণিতিক সূত্রের আলোকে। তাই মানব জীবনের পূর্ণাঙ্গ ব্যাখ্য বিজ্ঞান দিতে অক্ষম। কিন্তু দর্শন সেখানে সফল ও পূর্ণ।

৯. দর্শন আলোচনা করে সত্য, সুন্দর ও কল্যাণের যা মানুষকে সন্তুষ্টি এনে দেয়। তাই দর্শন মানেই বলা হয় জীবন দর্শন। অন্যদিকে, বিজ্ঞান সেদিক থেকে মানুষকে তৃপ্ত করতে পারে না। এটা তার আলোচ্য বিষয়ও নয়।

১০. বিজ্ঞান যেমন এটম বোমা আবিষ্কার করে কিন্তু তার ফল বা পরিণাম নিয়ে মূল্যায়ন করে না যে এটা মানব জীবনে আর্শিবাদ নাকি অভিশাপ ও ভয়বহতা বয়ে আনবে? অন্যদিকে, দর্শন তা ব্যাখ্য ও মূল্যায়ন করে।