বৈজ্ঞানিক ও লৌকিক ব্যাখ্যার মধ্যে পার্থক্য

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা (Scientific Explanation):

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মাধ্যমে প্রদত্ত বিষয়টিকে যুক্তিসম্মতভাবে বর্ণনা করা হয়। এ ক্ষেত্রে সাধারণ মানুষের অন্ধবিশ্বাসের উপস্থিতি থাকে না। আলোচ্য ঘটনার অন্তনির্হিত তাৎপর্য বিচার বিশ্লেষণ করে ঘটনার বাহ্যিক ও আভ্যন্তরীণ সম্বন্ধ গুলোকে ব্যাখ্যা করা হয়। অর্থাৎ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতি ও কার্যকারণ সম্পর্ক পর্যালোচনা করা হয়। যুক্তিবিদ কার্ভেথ রিড তাঁর Logic : Inductive বইয়ে বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা সম্পর্কে বলেন যে, ঘটনা সমূহের অন্তর্গত নিয়মাবলি আবিষ্কার করা, অনুমান করা এবং সংযুক্ত করাই হলো বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাকরণ।

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় সংযুক্তিকরণ ও অন্তভর্‚ক্তিকরণের প্রয়োজন রয়েছে। কোনো ঘটনাকে ব্যাখ্যা করতে হলে তার সাথে অন্যান্য জানা ঘটনার মিল খুঁজে সংযুক্ত করতে হয়। আর কোনো একটি নিয়মকে ব্যাখ্যা করতে হলে তাকে অপেক্ষাকৃত কোনো ব্যাপক নিয়মের অর্ন্তভূক্তিকরণ করতে হয়। অর্থাৎ, একটি ঘটে যাওয়া ঘটনার কার্যকারণকে যেমন আবিষ্কার করতে হয় আবার আলোচ্য ঘটনার সাথে অন্যান্য ঘটনার সাদৃশ ̈সমূহও নির্ণয় করতে হয়। তাই বলা যায়, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় প্রক…তির নিয়ম-কানুন অনুসরণ করে ঘটনাবলির মধে ̈ কার্যকারণ সম্পর্ক আবিষ্কার করে অন্যান্য ঘটনার সাথে সাদৃশ্য খুঁজে বের করে, সর্বোপরি অল্প ব্যাপক নিয়মকে অধিক ব্যাপক নিয়মের আওতায় আনা হয়।

লৌকিক ব্যাখ্যা (Popular Explanation):

প্রকৃতির নিয়মানুবর্তিতা নীতি ও কার্যকারণ সম্পর্ক যুক্তিবিদ্যার অন্যতম আলোচ্য বিষয়। আর এ দুটি বিষয় সম্পর্কে গ্রাম-গঞ্জের অতিসাধারণ মানুষের তেমন কোনো ধারণা নেই। তবে এসব ব্যক্তি প্রকৃতির প্রতিটি ঘটনারই ব্যাখ্যা দিয়ে যাবে তাদের নিজস্ব চিন্তা ও বিশ্বাস থেকে। সাধারণ মানুষ যেমন কিছু দৈব ও অতিপ্রাকৃত শক্তিতে বিশ্বাস করে তেমনি এরা বিভিন্ন প্রকার সামাজিক কুসংস্কার দ্বারা প্রভাবিত হয়। এদের মধ্যে বৈজ্ঞানিক জ্ঞান না থাকার কারণে যে কোনো ঘটনাকেই তারা অদৃশ্য শক্তির সাহায্যে ব্যাখ্যা দেয়।

সাধারণ মানুষের মনের মধ্যকার বিভিন্ন কুসংস্কার ও অন্ধবিশ্বাসের প্রতিফলনই হলো লৌকিক ব্যাখ্যা । এ ধরনের ব্যাখ্যায় কোনো বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের প্রয়োগ থাকে না। লৌকিক ব্যাখ্যা র ক্ষেত্রে বৈজ্ঞানিক জ্ঞানের উপস্থিতি থাকে না বলে এটিকে অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও (Unscientific Explanation)বলা হয়ে থাকে।

বৈজ্ঞানিক ও লৌকিক ব্যাখ্যার মধ্যে পার্থক্যঃ

বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা ও লৌকিক ব্যাখ্যার মধ্যকার পার্থক্যসমূহ খুব সহজে বোঝার জন্য নিচে বৈজ্ঞানিক ও লৌকিক ব্যাখ্যার মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে-

১. কোনো প্রাকৃতিক নিয়ম বা কার্যকারণ নীতির উপর নির্ভর না করে সাধারণ মানুষ সাধারণ উপলব্ধি থেকে যে ব্যাখ্যা প্রদান করে তাকে বলা হয় লৌকিক ব্যাখ্যা। অন্যদিকে, বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা হল ঘটনার নিয়ম আবিষ্কার, অবরোহন ও সংযুক্তকরণের মাধ্যমে ব্যাখ্যা।

২. কোনো ঘটনার বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা প্রদানের সময় কার্যকারণ সম্পর্ক নির্ণয় করা হয় এবং সঙ্গে সঙ্গে মৌলিক ও গুরুত্বপূর্ণ বৈশিষ্ট্য ও প্রাসঙ্গিকতার উল্লেখ করা হয়। অন্যদিকে, লৌকিক ব্যাখ্যায় থাকে অতি প্রাকৃতিক বিশ্বাস, কুসংস্কার, অন্ধ বিশ্বাস ও অপ্রাসঙ্গিক বিষয়।

৩. বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার ক্ষেত্রে ঘটনার কারণ আবিষ্কার করা গুরুত্বপূর্ণ বলে এ ক্ষেত্রে প্রকল্প প্রণয়ন করা যায়। অন্যদিকে, লৌকিক ব্যাখ্যায় ঘটনার কারণ নির্ণয় করাটা গুরুত্বপূর্ণ না হওয়ায় সেখান থেকে প্রকল্প প্রণয়ন করা সম্ভব নয়।

৪. বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় ঘটনার সদর্থক ও নঞর্থক, দূরবর্তী ও নিকটবর্তী শর্তসমূহকে সমন্বয় করে কারণের ব্যাখ্যা করা হয়। অন্যদিকে, লৌকিক ব্যাখ্যায় এভাবে কারণ নির্ণয় করা হয় না।

৫. বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় শ্রেণিকরণ করা হয়। কারণ বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যায় আলোচ্য ঘটনা ও অন্যান্য ঘটনার মধ্যে মৌলিক সাদৃশ্যের আলোকে তাদের একই শ্রেণিভুক্ত করা হয়। অন্যদিকে লৌকিক ব্যাখ্যায় এ ধরনের শ্রেণিকরণের অস্তিত্ব নেই।

৬. বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যার যথার্থতা যাচাই করা যায়। অন্যদিকে, লৌকিক ব্যাখ্যার যথার্থতা যাচাই করা সম্ভব হয় না। কারণ এখানে দৈবিক ও অবাস্তব বিষয়ের উল্লেখ থাকে যার যাচাই করা সম্ভব নয়।