সাধু ও চলিত ভাষার মধ্যে পার্থক্য

বাংলা ভাষার দুটি রূপ—সাধু ভাষা ও চলিত ভাষা। দুটি রূপের মধ্যে যেমন প্রকৃতিগত সাদৃশ্য রয়েছে, তেমনি পার্থক্যও রয়েছে। নিচে এ দুয়ের পার্থক্য আলোচনা করা হলো।

সাধু ভাষা

সাধু ভাষা হলো বাংলা লেখ্য গদ্যের অপেক্ষাকৃত প্রাচীন রূপ। এর নবীন ও বর্তমানে বহুল প্রচলিত রূপটি হলো চলিত। সাধু ভাষা অনেকটা ধ্রুপদী বৈশিষ্ট্যের এবং চলিত ভাষা অপেক্ষা স্বল্প প্রাঞ্জল। “সাধু” শব্দের এক অর্থ শিষ্ট, মার্জিত বা ভদ্ররীতি সঙ্গত। রাজা রামমোহন রায় তাঁর “বেদান্ত গ্রন্থ” রচনাটিতে শব্দটি ব্যবহার করেছিলেন। সাধু ভাষার সঙ্গে প্রমিত বা চলিত ভাষার মিশ্রণকে দূষণীয় গণ্য করা হয়। লেখার সময় যেকোনো একটি রীতিকে গ্রহণ করা বাঞ্ছনীয়। নচেৎ একে “গুরুচণ্ডালী” দোষে দুষ্ট আখ্যা দেওয়া হয়। তবে কবিতার ক্ষেত্রে ব্যতিক্রম দেখা যায়। অথাৎ বলা যায় যে, বাংলা ভাষার সংস্কৃত শব্দ-সম্পন্ন ক্রিয়া ও সর্বনাম পদের পূর্ণরূপ ও ব্যকরণসিদ্ধ উপাদান ব্যবহার করিয়া ইংরেজি গদ্য-সাহিত্যের পদবিন্যাসের প্রণালি অনুসরণে পরিকল্পিত যে সর্বজনীন গদ্যরীতি বাংলা সাহিত্যে প্রবর্তিত হয়, তাহাকে বাংলা সাধু ভাষা বলে ।

চলিত ভাষা

তদ্ভব শব্দ, ক্রিয়া ও সর্বনামের সংক্ষিপ্ত রূপ এবং লেখকের মনোভাব অনুযায়ী পদবিন্যাস প্রণালির ব্যবহারসহ যে স্বচ্ছন্দ, চটুল ও সর্বজনীন সাহিত্যিক গদ্যরীতি মুখের ভাষার আদলে গড়ে উঠেছে, তার নাম চলিত ভাষা। বাংলাদেশের উত্তরাংশসহ কলকাতা ও ভাগীরথী নদীর তীরবর্তী অঞ্চলের শিক্ষিত জনগণের মুখের ভাষার আদলে যে শক্তিশালী সাহিত্যিক গদ্য প্রবর্তিত হয়, তাই চলিত ভাষা বা চলিত গদ্য বলে খ্যাত। প্রমথ চৌধুরী, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর প্রমুখ চলিত গদ্যের সার্থক রূপকার।

সাধু ও চলিত ভাষার মধ্যে পার্থক্যঃ

১। যে ভাষায় সাধারণত সাহিত্য রচিত হয় এবং যা মার্জিত ও সর্বজনস্বীকৃত, তাই সাধু ভাষা। পক্ষান্তরে শিক্ষিত লোক সাধারণ কথাবার্তায় যে ভাষা ব্যবহার করে থাকে, তাই চলিত ভাষা।

২। সাধু ভাষা ব্যাকরণের সুনির্দিষ্ট ও সুনির্ধারিত নিয়মের অনুসারী। পক্ষান্তরে চলিত ভাষার সুনির্ধারিত ব্যাকরণ আজও তৈরি হয়নি।

৩। সাধু ভাষা গুরুগম্ভীর ও আভিজাত্যের অধিকারী। পক্ষান্তরে চলিত ভাষা সহজ ও স্বাভাবিক। এ ভাষা মানুষের মনোভাব প্রকাশে উপযোগী।

৪। সাধু ভাষার কাঠামো সাধারণত অপরিবর্তনীয়। পক্ষান্তরে চলিত ভাষা পরিবর্তনশীল।

৫। সাধু ভাষা কৃত্রিম। পক্ষান্তরে চলিত ভাষা কৃত্রিমতা-বর্জিত।

৬। সাধু ভাষা নাটকের সংলাপ, আলাপ-আলোচনা ও বক্তৃতায় তেমন উপযোগী নয়। পক্ষান্তরে চলিত ভাষা নাটকের সংলাপ, আলাপ-আলোচনা ও বক্তৃতায় বেশ উপযোগী।

৭। সাধু ভাষায় ক্রিয়া ও সর্বনাম পদগুলো সাধারণত দীর্ঘ হয়ে থাকে। যেমন—খাইতেছি, তাহারা ইত্যাদি। পক্ষান্তরে চলিত ভাষায় ক্রিয়া এবং সর্বনাম পদগুলো সংক্ষিপ্ত। যেমন—খাচ্ছি, তারা ইত্যাদি।

৮। সাধু ভাষা প্রাচীন। পক্ষান্তরে চলিত ভাষা আধুনিক।

৯। সাধু ভাষায় তৎসম শব্দের প্রয়োগ বেশি। পক্ষান্তরে চলিত ভাষায় অর্ধতৎসম, তদ্ভব, দেশি ও বিদেশি শব্দের প্রয়োগ বেশি।

১০। সাধু ভাষায় অপনিহিত ও অভিশ্রুতির ব্যবহার নেই। পক্ষান্তরে চলিত ভাষায় এদের প্রয়োগ লক্ষণীয়।