ডেভিস ও পেঙ্কের ক্ষয়চক্র মতবাদের মধ্যে পার্থক্য

ডেভিসের ক্ষয়চক্র মতবাদঃ
আর্দ্র নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ু অঞ্চলে নদীর ক্ষয় ও সঞ্চয়কার্যের ফলে ভূমিরূপের যে ধারাবাহিক ও পর্যায়ক্রমিক পরিবর্তন সাধিত হয়, তাকে স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র বলে।1899 খ্রিস্টাব্দে আমেরিকান ভূতত্ত্ববিদ উইলিয়াম মরিস ডেভিস তার স্বাভাবিক ক্ষয়চক্র মতবাদ প্রকাশ করেন। এই মতবাদটি ভৌগলিকগনকে ভূমিরূপ বিবর্তনের ব্যাখ্যায় শক্তিশালী হাতিয়ার প্রদান করেছে। ফলে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে ভূমিরূপ বিবর্তনের ব্যাখ্যা এক নতুন যুগের উন্মেষ ঘটেছে।

ডেভিসের মতানুসারে প্রত্যেকটি অঞ্চলেরই একটি স্বতন্ত্র জীবন ইতিহাস আছে। কোন নব উত্থিত ভূমিরূপ দীর্ঘদিন ধরে বিভিন্ন প্রাকৃতিক শক্তির (প্রধাণত নদীর) ক্ষয় ও সঞ্চয় কার্যের দ্বারা পরিবর্তিত বা বিবর্তিত হয়ে প্রায় সমতল ভূমিতে সমপ্রায় ভূমিতে পরিণত হয়। তাঁর মতে, “Landscape is a function of structure, process and Stage” অর্থাৎ ভূমিরূপের বিবর্তন কোন স্থানের ভূতাত্ত্বিক গঠন, ভূমিরূপ পরিবর্তনের পদ্ধতি ও অবস্থার ওপর নির্ভর করে।

পেঙ্কের ক্ষয়চক্র মতবাদঃ
জার্মান ভূমিরূপবিদ ওয়ালথার পেঙ্ক ভৌগোলিক চক্র (Geographical Cyclel তত্ত্বটির তীব্র সমালোচনা করে ঢালের প্রতিস্থাপন তত্ত্ব নির্ভরশীল ক্ষয়চক্রটিকে প্রদর্শন ও বর্ণনা করেন। পেঙ্কের তত্ত্বটির মূল ধারণার প্রজা সীকার্য বৈশিষ্ট্য হল- ভূমিভাগের রূপের পরিবর্তন ও বিবর্তনে অন্তর্জাত ও বহির্জাত বলের অনুপাত বিবেচনা করা। পেঙ্ক তাঁর তত্ত্বটির মূল ধারণায় উল্লেখ করেছেন যে, ভূ-আন্দোলনজনিত হারের উপর ভূভাগের ক্ষয়কার্যের হার ও ক্ষয়কার্যের ফলে উদ্ভূত ক্ষয়প্রাপ্ত পদার্থের অপসারণের হার নির্ভর করে।

আবার পেঙ্কের মতে, ভূভাগ আন্দোলনের ইতিহাস কয়েকটি বিশেষ বিশেষ ক্ষেত্রে উইলিয়াম মরিস ডেভিসের তত্ত্বের ভূ-আন্দোলনের ইতিহাসের অনুরূপ হলেও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে ভূভাগের ভূ-আন্দোলনজনিত উত্থান ও ক্ষয়কার্য একই সঙ্গে চলতে থাকে এবং ভূ-আন্দোলনজনিত হার বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মন্থর প্রকৃতির হয়। পেঙ্কের তত্ত্বটি প্রধানত শিলার ক্ষয়ের যথাযথ নিবিড় বৈজ্ঞানিক পর্যালোচনা ও বিশ্লেষণের উপর নির্ভর করে সৃষ্টি হয়েছে। নানান প্রকার আবহবিকার ও বিভিন্ন অবক্ষয় প্রক্রিয়ার দ্বারা সৃষ্ট শিলাগাত্র থেকে উদ্ভূত চূর্ণবিচূর্ণ পদার্থগুলির গতিশীলতার জন্য দায়ী থাকে।

ডেভিস ও পেঙ্কের ক্ষয়চক্র মতবাদের মধ্যে পার্থক্যঃ

ডেভিস ও পেঙ্কের ক্ষয়চক্র মতবাদের মধ্যে বেশ কিছু অমিল রয়েছে। তাই নিচে ডেভিস ও পেঙ্কের ক্ষয়চক্র মতবাদের মধ্যে পার্থক্য দেখানো হয়েছে-

১. ডেভিসের ক্ষয়চক্রের ধারনাটি একটি সময় নির্ভর অনুক্রম। অন্যদিকে, পেঙ্কের ক্ষয়চক্রের ধারনাটি একটি সময় নিরপেক্ষ অনুক্রম।

২. ভূমিরূপের বিবর্তন সম্পর্কীত ডেভিসের ক্ষয়চক্র তত্ত্ব টি একটি দ্রুত গতি সম্পন্ন প্রক্রিয়া অন্যদিকে, ভূমিরূপের বিবর্তন সম্পর্কীত পেঙ্কের ক্ষয়চক্র তত্ত্ব টি একটি দীর্ঘ কালীল ধারাবাহিক প্রক্রিয়া।

৩. ডেভিসের মতে ভূমিরূপ হল- গঠন, প্রক্রিয়া ও পর্যায়ের ফলস্রুতি। অন্যদিকে, পেঙ্কের মতে ভূমিরূপ হল- উত্থান ও ক্ষয়ের ফলস্রুতি।

৪. ভূ-উন্নয়নে ভূমি ঢালের কথা ডেভিস উল্লেখ করেননি। অন্যদিকে, পেঙ্কের মতে ভূমি ঢালেই ভূমিরূপ সৃষ্টি হয়। কাজেই ক্ষয় চক্রে ভূমি ঢাল অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ন।

৫. ডেভিসের মতে, ভূমিরূপের উত্থান পর্বের পরিসমাপ্তি যৌবন অবস্থা চলাকালীন কিংবা তাঁর আগেই ঘটে। অন্যদিকে, পেঙ্কের মতে, ভূমিরূপের উত্থান পর্ব পরিণত অবস্থা পর্যন্ত অব্যাহত থাকে।

৬. ডেভিসের মতে, ভূমিরূপের উত্থান পর্বের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয় কাজের প্রভাব বিশেষ থাকে না। অন্যদিকে, পেঙ্কের মতে, ভূমিরূপের উত্থান পর্বের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষয়কাজ শুরু হয়।

৭. ডেভিস এর ক্ষয়চক্র ৩ টি পর্যায়ের মধ্যে দিয়ে সম্পন্ন হয়। যথা: যৌবন, পরিনত ও বার্ধক্য। অন্যদিকে, পেঙ্ক ক্ষয় চক্রের কোন সুস্পষ্ট পর্যায়ের কথা উল্লেখ না করলেও তিনি ৩ টি ধাপের নাম উল্লেখ করেছেন। যথা: ক্রমবর্ধমান উত্থান, সম উত্থান ও ক্ষয়ীমান উত্থান।

৮. ডেভিসের ক্ষয় চক্রে শৈলশিরা সমূহের নিম্নমুখী ক্ষয়ের ফলে ভূমিরূপের উচ্চতা ক্রমশ কমতে থাকে। অন্যদিকে, পেঙ্কের ক্ষয়চক্রে শৈলশিরা সমূহের পশ্চাৎ দেশীয় ক্ষয়ের ফলে ভূমিরূপের উচ্চতা ক্রমশ কমতে থাকে।

৯. ডেভিসের ক্ষয়চক্রের সর্বশেষ পর্যায়ে ভূভাগটি প্রায় সমতলভূমি বা পেনিপ্লেনে পরিনত হয়। অন্যদিকে, পেঙ্কের ক্ষয়চক্রের সর্বশেষ পর্যায়ে যে সমতলভূমির সৃষ্টি হয়, তাকে পেঙ্ক এন্ডরাম্ফ নামে অভিহিত করেন।